পরিবর্তিত জলবায়ু ও বড়শীপাড়ার সংগঠিত তরুণ
রাজশাহী থেকে ইসমত জেরিন
বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো খরা। এই এলাকায় খরা হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে বৃষ্টিপাত কম হওয়া। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এই খরা আরও প্রকট আকার কারণ করেছে বরন্দ্রে এলাকায়। বলা হচ্ছে, বন উজাড় ও গাছপালা নিধন জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। বন উজাড় ও গাছাপালা নির্ধনের কারণে শুধু যে খরা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা কিন্তু নয়; সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাপমাত্রা। বরেন্দ্র এলাকার স্থানীয়দের মতে, ১০ বছর আগে যে পরিমাণে গরম পড়ত সেটি এখন অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। খরার কারণে বরেন্দ্র এলাকায় পানি সঙ্কট ক্রমশ প্রকট আবার ধারণ করছে। ফলশ্রুতিতে ফসল উৎপাদন নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফসল উৎপাদনের জন্য তাই কৃষকরা বাধ্য হয়ে ভূ-গর্ভস্থের পানি অধিক উত্তোলন করছেন। এতে করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরও নিচে নেমে গেছে। পানির স্তর ক্রমশ নি¤œমূখী হওয়ায় শুকনো মৌসুমে বরেন্দ্র এলাকার মানুষ চরম পানি সঙ্কটে পড়ছে; তাদের বাড়ির টিউবয়েলগুলো দিনকে দিন অচল হয়ে পড়ছে। ফলশ্রুতিতে মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন যেমন হচ্ছে ঠিক তেমনি নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
তরুণরা একটি সমাজের শক্তি, একটি সমাজের প্রাণ। একটি সমাজকে, একটি দেশকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রয়েছে তাদের। একটি সমাজের যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তারাই সর্বপ্রথমে এগিয়ে আসে এবং সেই প্রতিকূল অবস্থা থেকে সমাজকে উদ্ধারে তারাই অগ্রপথিক। তাদের প্রাণশক্তিতে সমাজ থাকে বেগবান। তরুণরা অনেকবার সেটি প্রমাণ করেছে। তাই ১৬ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার বাংলাদেশে রয়েছে তরুণদের কাজে লাগানোর এক অপার সম্ভাবনা। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, এদেশের মোট জনসংখ্যার ৩০%-ই হচ্ছে তরুণ। যাদের বয়স ১০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। ফলে তারুণ্যনির্ভর এই দেশে তরুণরা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন ইচ্ছাশক্তি, একতাবোধ, পরিশ্রম এবং সঠিক দিক নির্দেশনা। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে “দশের লাঠি একের বোঁঝা”। এই প্রবাদের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আমরা সবাই জানি যে, একজনের নিকট যে কাজটি অনেক বেশি কষ্টের সেটি অনেকে একতাবদ্ধ হয়ে করলে সহজ হয়ে যায়। তাছাড়া, একটি কাজ এককভাবে করতে গেলে অনেক সময় ব্যর্থতার কারণে নিজের মধ্যে হতাশা চলে আছে। কিন্তু সম্মিলিতভাবে করলে সেটি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এই একতা বদ্ধ হওয়া থেকেই তৈরি হয় বিভিন্ন সংগঠন ও ক্লাব যেখানে সকলেই একই ছাতার নিচে এসে একতাবদ্ধ হয় এবং সমাজ পরিবর্তনে কাজ করে।
বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মত বড়শী পাড়াতেও ১৫ থেকে ২৫ বছরের তরুণদের সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করে সমাজকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রয়েছে এখানকার তরুণদের। সম্মিলিতভাবে এবং সম্মিলিত শক্তিতে কাজ করার জন্য এই পাড়ার তরুণরা তাই গড়ে তুলেছেন আলোর পথে তরুণ সংঘ। এই সংঘের মাধ্যমেই খাদ্য সমস্যার সমাধানের জন্য তরুণরা শুরু করেছেন খরা সহিষ্ণু ধান চাষ। সংগঠনের এই উদ্যোগটি যদি সফল হয় তাহলে ভূগর্ভস্থ পানির উপরে চাপ অনেকটা কমে আসবে বলে তারা আশা করছেন। ধান ছাড়াও অন্যান্য ফসল যেগুলোতে পানি কম লাগে সেগুলোও চাষাবাদের উদ্যোগ নিয়েছেন এই তরুণরা। ইতিমধ্যে খরা মোকাবেলায় সংগঠনের সদস্যরা বৃক্ষ রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ নিয়েছেন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তরুণরা এ পর্যন্ত ১৫০টি বনজ, ফলজ ও ঔষুধি বৃক্ষ রোপণ করেছেন। রোপণকৃত গাছগুলোর পরিচর্যাও করছেন সংগঠনের সদস্যরা। তাদের মতে, উদ্যোগটি আপাতদৃষ্টিতে ছোট মনে হলেও একসময় তাদের দেখে অন্যান্যরা অনুপ্রাণিত হবে এবং বরেন্দ্র অঞ্চল সবুজে ভরে যাবে।
এই তরুণ সংঘটি কমিউনিটি পাটশালা নামে একটি নতুন কর্যক্রম শুরু করেছে। এই কার্যক্রমের আওতায় তারা নিয়মিতভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং ঝুঁকি প্রশমনে করণীয় বিষয়ে বিভিন্নজনের সাথে আলোচনা করেন। সংগঠনের সদস্য, শিক্ষক এবং গ্রামের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আলোচনায় অংশ নেন। এখানে বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনা করে থাকেন। এই সব আলোচনা থেকে নতুন প্রজন্ম অনেক কিছু শিখতে পারে বলে সংগঠনের সদস্য ও গ্রামের মানুষরা মনে করেন। আলোচনা থেকে উঠে আসা সফল ও ভালো উদ্যোগগুলো অন্য মানুষের মাঝে পৌছে দেওয়ার জন্য তরুণ সংঘটি সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে। এভাবে সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে তারা এলাকার জলবায়ুজনিত সমস্যা সমাধানে নিজেরাই উদ্যোগী হয়েছে। কোনক্ষেত্রে কোনক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছেন। তাদের সফলতার গল্পগুলো অন্যরাও জানতে পারছেন এবং নিজেদের এলাকায় প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন।
অন্যদিকে সংগঠনের সদস্যরা আরেকটি বড় উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন, সেটি হচ্ছে পানির অপচয়রোধে জন সচেতনতা বৃদ্ধি করা। সংগঠনের সদস্যরা জানান, “ঝঃড়ঢ় ঃযব উৎড়ঢ়” শিরোনামে তারা একটি প্রচারণা চালাতে শুরু করতে যাচ্ছেন। এই প্রচারণার মাধ্যমে তারা একটি সমীক্ষা করবেন। এই সমীক্ষার মাধ্যমে তারা পরিবার প্রতি পানির ব্যবহার ও অপচয় সংক্রান্ত তথ্যগুলো জানার চেষ্টা করবেন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এই প্রচারণার আওতায় তারা এলাকায় জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন ফেসটুন ও পোস্টারও লাগাবেন। প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে পানির অপচয় বন্ধে মানুষকে সচেতন করবেন বলে জানান।
পানির সুষ্ঠু ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গাছ রোপণ ছাড়াও তারা সামাজিক নানান সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন। সমাজ থেকে বাল্যবিবাহ, যৌতুক, নারী নির্যাতন ও মাদকাসক্ত ইত্যাদি সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানে প্রচার, প্রচারণ ও জনসচেতনমূলক কাজ করছেন। তবে বর্তমারেন তারা জলবায়ু বিষয়ক ইস্যুগুলোকে বেশি প্রধান্য দিচ্ছেন। কারণ তারা অনুধাবন করতে পেরেছেন যে, এখনই যদি এই জলবায়ু সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ করা না গেলে তাহলে সেটি ভবিষ্যতে আরও মারাত্মক রূপ ধারণ করবে, যা সমাধান করা কষ্টকর হবে।
আলোর পথের তরুণ সংঘের পথচলাটি একদিনেই এই পর্যায়ে আসেনি। তাদের পথচলার সহযোগী হিসেবে উন্নয়ন সংগঠন বারসিকও একটি সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। ২০১৬ সালে বারসিক বড়শীপাড়ায় কাজ শুরু করে। সংগঠনটি বরাবরই তরুণ প্রজন্মকে তাদের কাজের সাথে সম্পৃক্ত করতে চায় এবং যুব সমাজকে সমাজ পরিবর্তনে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। বড়মীপাড়াা তরুণরাও তাদের জায়গা থেকে এগিয়ে আসে এবং এলাকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা শুরু করে। এভাবে সক্রিয়ভাবে কাজ করা এবং নিবিড় মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে ২০১৬ সালের ৩রা মে “আলোর পথে তরুণ সংঘ” নামের এই যুব সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ৩০ জন। যাদের মধ্যে ২০ জন পুরুষ আর ১০ জন নারী। এদের মধ্যে কেউ শিক্ষার্থী আবার কেউ পেশাজীবী, কেউ বিবাহিত আবার কেউ অবিবাহিত, কেউ মুসলিম আবার কেউ হিন্দু। এই সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভিন্নতা থাকলেও তাদের সবার একটিই পরিচয় তারা যুব সমাজ, তারা আলোর পথে তরুণ সংঘের সদস্য এবং সমাজ ও দেশ পরিবর্তনে একতাবদ্ধ।
মানুষ পারে না এমন কোন কাজ নেই। মানুষ যেমন পরিবেশকে ঝুঁকিপূর্ন করতে পারে তেমনি ঝুঁকিমুক্তও করতে পারে কিন্তু তার জন্য দরকার ইচ্ছা ও সঠিক দিক নির্দেশনা। আর দেশের তরুন সমাজ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে পারে কারন বাংলাই একটি বিখ্যাত উক্তি আছে এইরকম, “এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ্য সময় তার” তবে এখানে বন্ধুক নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে না। এখানে জলবায়ুগত পরিবর্তনের সাথে যুদ্ধ করার কথা বলা হচ্ছে যেখানে নিজের ইচ্ছা ও আতœশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে যেটি করছে আলোর পথে তরুণ সংঘ। আমাদের সমজে অনেক সময় তরুন সমাজকে নেতিবাচক হিসাবে দেখা হয় কিন্তু সহযোগীতা ও দিক নির্দেশনা পেলে তারাও যে ভাল কিছু করতে পারে তার একটি বড় উদাহরন হচ্ছে বড়শী পাড়ার সংগঠিত তরুনরা।