দেশিয় সাদা বকের অস্তিত্ব রক্ষায় প্রয়োজন কীটনাশকমুক্ত ফসল উৎপাদন
ঘিওর, মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক:
পঞ্জিকার হিসাবে এখন বসন্তকাল। প্রকৃতিতে সবুজ তার অপরূপ সুন্দরের প্রতীক বিস্তার করতে শুরু করেছে। শুরু হয়েছে নতুন মৌসুমে ফসলের আবাদ। শীত বিদায় নিলেও এর আবেশ এখনো প্রকৃতিতে বিদ্যমান। তাই তো এখনো শীতের পাখিদের দেখা মেলে জলাশয়ে। তাই তো ফসলের মাঠে ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বক যেন চিরন্তন বাংলার রূপ।
এই সময়টাতে মানিকগঞ্জের চকে ও জলাশয়ের ধারে দল বেঁধে বের হয় দেশি সাদা বক। দেখে মনে হয় এ যেন বকের মিলন মেলা। চাষ করার সময় শত শত বক উড়ে এসে লাঙ্গলের ফলার চার পাশে ঘিরে থাকে। মাটির নিচের পোকামাকড় খায়। এদিকে ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বক দেখে অনাবিল আনন্দ পায় সব বয়সী মানুষ।
“ঐ দেখা যায় তালগাছ, ঐ আমাদের গাঁ। ঐখানেতে বাস করে কানাবগীর ছাঁ…………।” এই সেই কানাবগী, ধবল বক। সাদা মেঘে ঢাকা উজ্জল আকাশে উড়ে বেড়ায় দৃষ্টি সীমানায়। ঘিওর, মাইলাঘী, বাঙ্গালা, দিঘুলিয়া চকে দেখা যায়, ওপরে সাদা মেঘ আর ফসলের কাঁদা জলে সাদা বকের অবস্থান; মিলিমিশে যেন একাকার। যেন বকের অভয়াশ্রম।
লম্বা ঠোট, হলুদ চোখ, ধুসর বাদামী পিঠ, মাথা-গলা এবং বুকে বাদামী সাদা ডোরা, বুকের নিচে পেট থেকে লেজ বরাবর সাদা আর লম্বা হলুদ পা। এরা কানাবক বা কানিবক নামে পরিচিত। এক সময় এদের প্রচুর দেখা মিলতো বিল, পুকুর, ডোবায়, ফসলের মাঠে। সাধারণত পানির ধার ঘেঁষে সাদা বক বসবাস করে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাছের মগ ডালে বাসা বাঁধে। আর এই পাখির প্রধান খাদ্য তালিকার মধ্যে রয়েছে মাছ ও পোকামাকড়। এছাড়া ফসলি জমিতে পোকামাকড় দমনে এদের ভূমিকা অপরিসীম।
বক এখন শুধু প্রকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাই করে না; এদের অবদান রয়েছে অর্থনীতিতেও। এই পাখিটি এখন দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। শুধুমাত্র গ্রামগঞ্জে ফসলের জমিতে ও শহরের লেকগুলোতে শীতের মৌসুমে দেখা মিলে এই বকের। প্রতিবছর এই মাঘ-ফাল্গুন থেকেই ইরি ধান বপণ শুর হয়। ইরি ধান ক্ষেতে পানি দেওয়ার পরপরই দেখা মিলে এই সাদা বকের। এ যেন ফসলের কাঁদা মাটিতে সাদা বকের মিলন মেলা। ইরি মৌসুমে ফসলের জমিতে পানি দেওয়ার পর থেকে পোকামাকড় ভাসতে থাকে আর সকাল ও বিকালে এই বক তা খুটে খুটে খায়। মাছ ছাড়াও এসব পাখি শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া, মাজড়া , ফড়িং , পামরি ও জলজ পোকামাকড় খেয়ে ফসলের উপকার করে।
তবে বর্তমানে ফসলের জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক দেওয়া হচ্ছে। তাতে বকসহ অন্য কোন ধরনের উপকারি পাখি সে ফসলের জমিতে বসছে চাচ্ছে না। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ওদের খাদ্যাভাব থাকা সত্ত্বেও রয়েছে নিরাপত্তার অভাব। ফলে কমছে এদের চারণভূমি, কমছে বকের সংখ্যাও। ফাঁদ ও গুলি করে শিকার করছে এক শ্রেণির অসাধু মানুষ। এখানেই শেষ নয়; বকের ডিম ও বাচ্চা বাসা থেকে নিয়ে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এদের নিয়ে চলছে জমজমাট ব্যবসা। আমাদের দেশে অতিথি পাখির নিরাপত্তা আইনের যথেষ্ট প্রয়োগ থাকলেও দেশীয় পাখির নিরাপত্তায় কোন র্কাযকর পদক্ষেপ নেয় না কেউই।
ঘিওর উপজেলার রাথুরা এলাকার কৃষক মোঃ কবির জানান, “এই সাদা বক আমাদের অনেক উপকার করে। ইরি ধান বপনের পর জমিতে মাজরা পোকা, পামরি পোকা, কেছো, ফড়িং, তুরকুলা পোকা দেখা যায়। এতে ফসলের অনেক ক্ষতি হয়। ক্ষেতে পানি দেওয়ার পর এই সব পোকা ভাসতে থাকে আর বক তা খুটেখাটে খায়। এতে করে ফসলের উপকারে আসে।”
বিশিষ্ট কবি ডা. মো. আবুল হাসান বলেন, “এখন আর আগের মতো বক দেখা যায় না। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বক ইরি ধান খেতের পোকা মাকড় খেতো। ফসলের জমিতে ক্ষতিকারক কীটনাশক এবং শিকারিদের কারণে বকের দেখাই এখন পাওয়া যায় না।”
মানিকগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আলিমুজ্জামান মিয়া বলেন, “সাদা বক আমাদের প্রাকৃতিক বন্ধু। ফসলের জমিতে বিষাক্ত পোকামাকড় খেয়ে আমাদের ফসলের উপকার করে।”
বর্তমান বিশ্বে এখন খুব জোরেসোরে চলছে পরিবেশ সংরক্ষণ এর কথা। বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন এর জন্য কীটনাশক ব্যবহার কমাতে হবে। পরিবেশ সুন্দর রাখার জন্য আমাদের সমন্বিত পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা ভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহারের প্রতি কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে। আর এভাবেই আমাদের দেশের সকল উপকারি পাখি ফসলের জমিতে ক্ষতিকর পোকা মাকড় খাওয়ার কাজে লাগাতে পারবো। এতে করে মাটি তার পরির্পূণ পুষ্টি পাবে, ফসল হবে ভালো আর কৃষক হবে লাভবান। পাশাপাশি বেঁচে থাকবে সাদা বক- প্রাণ জুড়াতে আমাদের।