বাঘে ধরা হাসমতের গল্প
সাতক্ষীরা থেকে নাহিদ আহমেদ
বাপ-দাদাদের পেশা আকড়ে ধরে বাদায় যেতেন হাসমত সরদাররা। সেদিনও তিন ভাই ছিলেন এক সাথে। সারাদিন সুন্দরবনের এ’খালে ও’খালে মাছ ধরে রাতে বনের এক কোনে কাচিকাটা খালে নৌকা ভীড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন তারা। হঠাৎ নৌকায় হানা দেয় বাঘ। মুখে হাতা মেরে তিন ভাইয়ের মধ্যে হাসমতকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল বাঘ। লোকাচার অনুযায়ী অনেকটা যুদ্ধ করেই বাঘের হাত থেকে হাসমতকে রক্ষা করেন তার দুই ভাই।
তবে, প্রাণে বাঁচাতে সক্ষম হলেও বাঘের থাবায় বিধ্বস্ত হয়ে যায় হাসমতের বাম চোখ, নাক, মুখসহ গোটা মুখম-লের বাম অংশ। এরপর খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টানা দুই বছর চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। কিন্তু এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বিড়ালক্ষ্মী গ্রামের মৃত মুনছুর সরদারের ছেলে হাসমত সরদার।
একবার বাঘের হাত থেকে ফিরেও ফের বাদায় যেতে লাগলেন হাসমত সরদার। হঠাৎ একদিন তার সামনে থেকেই বাঘে তুলে নিয়ে যায় শ্যামনগর উপজেলার কৈখালীর হাসনাতকে। তারপর থেকে আর বাদায় পা দেননি তিনি।
নিজের জন্য দৈনিক ১০৫ টাকার ওষুধসহ স্কুলে পড়–য়া তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কোনমতে দিন চলে তাঁর। কিন্তু কেউ কখনও সাহায্যের হাত বাড়ায়নি তার দিকে। আর এভাবেই চলেছে ২১টি বছর।
নানা সামাজিক প্রবঞ্চনা সহ্য করেও জীবন সংগ্রামে লড়ে যাচ্ছেন আত্মপ্রত্যয়ী হাসমত।
এখন সেট থেকে মাছ কিনে তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। কিন্তু তাতে সংসার চলে না তাঁর। ওষুধ কিনতেই চলে যায় আয়ের অর্ধাংশ।
একান্তে আলাপকালে হাসমত বলেন, ‘১৫ বছর বয়স থেকেই জঙ্গলে যেতাম আমি। ১৮ বছরের মাথায় বাঘে ধরে। এখন ৩৯। এই ২১ বছর কিভাবে যে জীবন চালায়ছি, সে আমি জানি।” তিনি আরও বলেন, “বাপের তিন বিঘা জমি বিক্রি কইরে ভাইরা আমার চিকিৎসা করিল। এখন ১০ কাঠা জমিতে আমরা সাত ভাই পরিবার পরিজন নিয়ে থাকি। আমার কোন ঘর ছেল না। স্থানীয় এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কোন মতে একটা দু’চালা ঘর দিছি। এখনো টাকা শোধ দিতি পারিনি। পাঁচজনের সংসার। ওষুধ কিনতি সব যায়।”
বাড়ির বাইরে কাপড় দিয়ে মুখ বেধে চলেন হাসমত। তা না হলে তাকে দেখে ভয় পায় সবাই। কেউ তার পাশে আসতে চান না।
হাসমত বলেন, “ডাক্তাররা প্লাস্টিক সার্জারি কইরে মুখে চামড়া লাগিয়ে দিল। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি, ইনফেকশন হয়। দু’দিন ভালো, তো তিন দিন খারাপ, যন্ত্রণা হয়। অনেক কষ্ট কইরি দুই ছেলে ও এক মেয়েকে স্কুলে পাঠায়। আমি কাজ কইরি খাই। কিন্তু এতো ব্যয়বহুল চিকিৎসা কি আমাগির দ্বারা সম্ভব। আপনারা শুধু ছবি তুইলি নিয়ে যান, তাতে লাভ কি?” প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি।
সুন্দরবন গবেষক পিযুষ বাউয়ালী পিন্টু বলেন, “এতো কিছুর পরও হাসমত যেভাবে জীবনযাপন করছে তা সকলের কাছে অনুকরণীয়। অবশ্যই তাঁর চিকিৎসার জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসা উচিত।
এজন্য তাকে নিয়মিত চিকিৎসা ভাতা প্রদানের দাবি জানান তিনি।