৬২০ টাকা মূলধনে সাতক্ষীরার সাইফুল আজ লাখপতি!
সাতক্ষীরা থেকে মো. আসাদুজ্জামান
মাত্র কয়েক বছর আগে নিজের সম্বল ৬২০ টাকা নিয়ে রঙিন মাছের চাষ করে আজ ১৬টি পুকুরের মালিক তিনি। ব্যবসায়ীদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে সমাজের মানুষকে দেখিয়ে দিলেন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার ব্রজবাক্স গ্রামের সাইফুল ইসলাম।
এক সাক্ষাৎকারে সাইফুল বলেন, “একসময় আমি জমি কেনার বিষয়টি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। কিন্তু আজ ব্যবসা করে জমি কিনে বড় ছেলের নামে হ্যাচারি গড়ে তোলার কাজ প্রায় শেষের দিকে। একসময় অন্যের অধীনে কাজ করতাম। এখন আমার আমার অধীনে অনেকে কাজ করেন। আমি শ্রমিক ছিলাম! এজন্য শ্রমিকের কষ্ট বুঝি!” তিনি বলেন, “এই রঙিন মাছ এক সময় বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। এখন সেটি আমার হ্যাচারিতে উৎপাদন হচ্ছে।”
সাইফুল জানান, একসময় তাদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না। পারিবারিক দৈন্যদশার কারণে ভারতে গিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে। সেখানে গিয়ে রঙিনমাছ উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানে খুব সামান্য বেতনে চাকরি করতেন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর ভালোবাসার টানে আবারও দেশে ফিরে আসেন। তারপর রাজধানীর মিরপুরে একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু সেখানেও বিধিবাম। মাস শেষে যে টাকা বেতন পেতেন, তা দিয়ে বাসা ভাড়া দেওয়ার পর অবশিষ্ট টাকা দিয়ে আর সংসার চলতো না।
তিনি বলেন, “পরে ঘরে ছেলে ঘরে ফিরে এলাম। এক বন্ধু রঙিন মাছের চাষ করতেন। তার কাছ থেকে ছয় জোড়া ব্রুড মাছ (মা-মাছ) সংগ্রহ করে মাছ চাষ করি। সেই ছয় জোড়া মাছ থেকে এখন এক যুগ পর অর্থ কয়েক লাখ টাকায় গিয়ে পৌঁছেছে।”
মাছ চাষ করেও জীবিকা নির্বাহ করা যায়, উল্লেখ করে সাইফুল জানান, অনেকে বিদেশি মাছ বাদ দিয়ে তাঁর এখানে আসেন মাছ কিনতে। তিনি বলেন, “একসময় দেখতাম, সব মাছ বিদেশে থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু এখন আমার হ্যাচারিতে উৎপাদন করা মাছ সাতক্ষীরার চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে।” দেশের রঙিন মাছের চাহিদা পূরণ করে ফেনী। এরপর তিনি দ্বিতীয় স্থানে আছেন বলে জানান। রঙিন মাছের জন্য দেশের সবচেয়ে বড় বাজার হলো রাজধানীর ঢাকার কাঁটাবন। সেখান থেকে অনেকে তাঁর কাছ থেকে রঙিন মাছ কিনে নিয়ে যান।
সাইফুল জানালেন, তিনি নিজে বিশেষ পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদন করছেন। এর মধ্যে মিল্কি কই কার্প, কিচিং গোরামি, কই কার্প, কমিটিসহ ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির রঙিন মাছ রয়েছে। বেশ ভালো দামে তিনি এ সব মাছ বিক্রি করেন। তার মাছ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে।
সিল্কি নামে একটি মাছের রঙ তৈরি করেন সাইফুল। দেখতে জরি কাগজের মতো। সে জন্য তিনি নাম দিয়েছেন সিল্কি। তিনি বলেন, “একটি মাছের রঙ একটু পরিবর্তন করলে সেটি দেখতে আরো ভালো লাগে। সে কারণে মাছের রঙ পরিবর্তন করি।”
রঙিন মাছের চাষ করে নিজের আর্থিক অবস্থা বদলেছেন সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, “আমাদের সংসারে এখন আর অভাব নেই। আমাদের মূলধন এখন ২০ লাখ টাকা। স্ত্রী জেসমিন সুলতানা ও দুই ছেলে নিয়ে এখন সুখের সংসার তাঁর।
সাইফুল বলেন, “প্রথমে একটি পুকুর লিজ নিয়েছিলাম। এখন লিজ নেওয়া পুকুরের সংখ্যা ১৬টি। এসব পুকুরে বিভিন্ন জাতের রঙিন মাছের পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে। বড় ছেলের নামে ‘রেজা অ্যাকুরিয়াম ফিস’ নামে রঙিন মাছের হ্যাচারির জন্য কাজ শুরু করে দিয়েছি।” তিনি আরো বলেন, “আমি এক সময় অন্যের শ্রমিক ছিলাম। আর আমার অধীনে এখন ২৫ জন শ্রমিক কাজ করে।”
মাছ চাষ সম্পর্কে সাইফুল জানান, আমাদের এখানে আরো ভালো রঙিন মাছ উৎপাদন করা যায়। এখানকার মাছের দাম ১০ টাকা থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। তিনি বলেন, “সহজ শর্তে ব্যাংক থেকে ঋণ পেলে এ ব্যবসা আরো সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে।” সরকারের পক্ষ থেকে একটু সহযোগিতা পেলে আরো ব্যাপকভাবে চাষ করে রঙিন মাছ বিদেশে রফতানির সুযোগ রয়েছে বলে জানান সাইফুল।
এ বিষয়ে সাইফুলের স্ত্রী জেসমিন সুলতানা বলেন, “আমি আমার স্বামীর কাজে সাহায্য করি। ২০০৪ সালে আমার স্বামী আর আমি যখন মাছচাষ শুরু করি, তখন আমাদের তেমন মূলধন ছিল না। পরে একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে মাছের চাষ অনেক বাড়িয়েছি। আমরা এখন সফল উদ্যোক্তা। যখন শুনি, আমাদের উৎপাদন করা মাছ রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে, তখন আনন্দে ও গর্বে মনটা ভরে যায়।”
সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল এলাকার বোরহান উদ্দিন, ছোটবেলা থেকে রঙিন মাছ পোশার শখ। সেই থেকে এটি এ্যাকুরিয়ামে মাছ চাষ করেন। কিন্তু আগে বিদেশ থেকে মাছ আমদানি করতো হতে সে জন্য মাছের দাম অনেক বেশি ছিল। তিনি বলেন, “আমাদের জেলার সেই রঙিন মাছ চাষ হচ্ছে এজন্য মাছের দাম অনেক কমে এসেছে।”
সাতক্ষীরার শহরের পপুলার এ্যাকুরিয়ামের সত্বাধিকারী শহিদুল্লাহ বলেন, “একসময় রঙিনমাছ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। সাইফুল ভাই মাছ উৎপাদন করার পর এখন আমদানি করতে হচ্ছে না। দামও তুলনামূলক অনেক কম।” তিনি জানান, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ওই সব রঙিনমাছের খাবারের দামও বেশি। সে কারণে মানুষ এখন দেশে উৎপাদিত রঙিনমাছ বেশি কিনছেন। তিনি বলেন, “সাইফুল ভাইয়ের মাছ টেকসই, প্রতিকূল আবহাওয়াতেও অনেক দিন টিকে থাকে। আর দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় শৌখিন মানুষ দেশীয় রঙিন মাছের দিকেই ঝুঁকছেন।