আমি প্রকৃতির, প্রকৃতি আমার
বাহাউদ্দীন বাহার ও সিলভানুস লামিন
‘পরিবেশ দিবস’ কথাটা মাথায় আসলে মনে হয় গাছ লাগাই। পরিবেশ দিবস পালিত হয় প্রতিবছর ৫ জুন। আর জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের বর্ষা ঋতু। যা গাছ লাগানোর জন্য একবারেই উপযোগি। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দেখে আসছি পরিবেশ দিবস উপলক্ষে গাছ লাগানো কার্যক্রম। একসময় পরিবশে দিবস উপলক্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীদের মাঝে বন বিভাগ থেকে বিনামূল্যে গাছ বিতরণ কর্যক্রম চালু ছিল। তাই এখনো মাথার ভিতর পরিবেশ দিবস উপলক্ষে গাছ লাগানোর বিষয়টিই সবার আগে মাথায় আসে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পরিবেশের সমার্থক শব্দ কি তাহলে গাছ? পরিবেশের অন্যতম উপাদান কি তাহলে গাছ? নাকি পরিবেশ রক্ষা করতে শুধু গাছই যথেষ্ট?
পরিবেশ দিবসের সংজ্ঞাটা একটু দেখে নেওয়া যাক। বাল্য বয়স থেকে শিখে এসেছি ‘আমাদের চারপাশে যা আছে তাই নিয়ে আমাদের পরিবশে।’ আমাদের চারপাশে কি শুধু গাছ থাকে; কখনোই নয়! আমাদের চারপাশে গাছ ছাড়াও রয়েছে নানান প্রাকৃতিক উপাদান। উদ্ভিদ, প্রাণী, মাটি, বায়ু, নদীনালা, খালবিল, পাহাড়, অরণ্যসহ অসংখ্য উপাদান। তবে এটা ঠিক যে, আমাদের চারপাশে প্রকৃতির অসংখ্য উপাদানের মধ্যে গাছ একটি। গাছের সাথেই আমরা বেশি পরিচিত হই। এটাও ঠিক যে, গাছই আমাদেরকে বাঁচায়। কারণ গাছ যদি অক্সিজেন উৎপাদন বন্ধ করে দেয় তাহলে মানুষসহ অক্সিজেনের ওপর নির্ভরশীল অসংখ্য প্রাণী নির্ঘাত মারা যেতো। তাই গাছ লাগানো অবশ্যই একটা ভালো উপায় হতে পারে পরিবেশকে ভালো এবং সুস্থ রাখার জন্য। তবে সামগ্রিকভাবে পরিবেশ তখন ভালো ও সুস্থ থাকবে যখন গাছের পাশাপাশি আমাদের চারপাশের অবস্থানকারী গাছসহ ঘাস, গুল্ম, মাটি, বায়ু, নদীনালা, খালবিল, ক্ষুদ্র ও বৃহৎ প্রাণী প্রতি যত্নবান ও দায়িত্বশীল হই। দায়িত্বশীল ও যত্নবান হলে আমরা এগুলো ধ্বংস করবো না, কেউ যাতে এগুলো ধ্বংস না করতে পারে তার জন্য আমরা সোচ্চার হবো।
পরিবেশকে শুদ্ধ, নির্মল ও সুস্থ রাখার জন্য শুধু গাছ লাগালে চলবে না; তা কিন্তু যথেষ্টও নয়। গাছ ছাড়াও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানকে ভালো রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রকৃতিতে একটি ঘাস, একটি গুল্ম, একটি ছোট প্রাণী, একটি বহৎ প্রাণীকে ভালো রাখার উদ্যোগ নিতে হয় মানুষকে। শুধু তাই নয়। এ গাছ, ঘাস, গুল্ম যাতে সবল ও সতেজ হয় এজন্য মাটিকেও যত্ন রাখতে হয়। যত্ন রাখতে হয় নদী, নালা, খাল বিলকেও। কারণ প্রাকৃতিক উপাদান প্রতিটিরই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। একটি প্রাকৃতিক উপাদান বিলুপ্ত হলে এর প্রভাব অন্য উপাদানের ওপরও পড়ে। এজন্য পরিবেশকে সুন্দর, ভালো, নির্মল ও বিশুদ্ধ করার জন্য পরিবেশ তথা প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকেই আমাদের চিনতে হবে, জানতে হবে এবং বুঝতে হবে। গাছের মতো করে অন্যান্য উপাদানকেও যত্ন করতে হবে, তাদেরকে সংরক্ষণ করতে হবে এবং সেগুলোর বিস্তার ও বিকাশ করতে হবে। পরিবেশ ও প্রকৃতিকে জানার, বুঝার ও উপলদ্ধি করার এবারের পরিবেশ দিবস ২০১৭ এর প্রতিপাদ্য যথার্থ। কেননা এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়টি প্রকৃতির কাছকাছি কিংবা প্রকৃতির সাথে মানুষকে বসবাস করতে উৎসাহিত করছে। “Connect with Nature”এই প্রতিপাদ্যটি, যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার “আমি প্রকৃতির, প্রকৃতি আমার” শিরোনামে উদযাপন করছে, সেটি আমাদেরকে প্রকৃতিকে তার মতো করে উপলদ্ধি করার অবকাশ দিয়েছে।
প্রকৃতিকে সৃষ্টিকর্তা বৈচিত্র্যময়তায় পরিপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। এই বৈচিত্র্য বিনষ্ট হলে, লুপ্ত হলে পরিবেশের ক্ষতি হবে। ‘আমাদের’ বলতে শুধুমাত্র মানুষকে চিন্তা করলে মানুষ ভুল করবে, আমাদের বলতে অন্যান্য প্রাণ ও উপাদানকে নির্দেশ করে। আবার ‘চারপাশ’ মানে বিশ্বব্রহ্মান্ডের বিভিন্ন উপাদান ও সৃষ্টিকে নির্দেশ করে। পরিবেশকে ভালো ও নির্মল রাখতে হলে মানুষ যেমন তার মতো মানুষের প্রতি যত্নবান হতে হবে ঠিক তেমনি প্রকৃতির প্রতিটির সৃষ্টিকেও আপন করে নিতে হবে। কারণ পরিবেশের প্রতিটি উপাদানই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তবে প্রকৃতির উদ্ভিদ, প্রাণী এবং মানুষ পরস্পরের ওপর তখন বেশি নির্ভরশীল হবে যখন প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য থাকবে সমৃদ্ধ। এই বৈচিত্র্যের বিভিন্ন উপাদানকে ঘিরে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক শক্তিশালী হয়। পারস্পরিরক সম্পর্ক শক্তিশালী হলে পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানই ভালো থাকবে, বিকশিত হবে। যেমন, বিভিন্ন উদ্ভিদের ফল, ফুল আছে বলেই পাখিরা সেই উদ্ভিদের সংস্পর্শে আসে। সেই ফুল ও ফল খেয়ে বেড়ে উঠে। সেই উদ্ভিদের ফল ও ফুল খেয়ে মলের মাধ্যমে তারা অন্য এলাকায় এসব উদ্ভিদের জন্ম দেয়; বৈচিত্র্যকে আরও বিকশিত করে। আবার বনের বিভিন্ন ছোট ছোট উদ্ভিদ ও প্রাণী আছে বলেই পোকামাকড় থেকে শুরু করে বড় আকারের প্রাণীগুলো সেই সব ছোট উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংস্পর্শে আসে; খাদ্য হিসেবে যেমন সেগুলো গ্রহণ করে তেমনিভাবে সেগুলোকে লালন-পালন করে যাতে তাদের খাদ্যের কোন সমস্যা না হয়। এভাবে তাদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক ও নির্ভরশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান সেটা খাদ্য হোক, ওষুধ হোক, ফল হোক পরস্পরের সাথে বিনিময় ও সহভাগিতা করার মাধ্যমে মানুষে মানুষে সম্পর্ক ও নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। ‘আমাদের’ ও ‘চারপাশ’ প্রত্যয়টি দু’টির বিশ্লেষণে আমরা বুঝতে পারি, ‘পরিবেশ’ মানে মানুষসহ প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান ও প্রাণকে নির্দেশ করে। পরিবেশকে ভালো রাখতে হলে, সুস্থ রাখতে হলে এবং নির্মল করতে গেলে প্রতিটি প্রাণ ও উপাদানের প্রতি যত্নবান ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
২০১৭ সালের প্রতিপাদ্য বিষয়টিকে বাংলায় রূপান্তর করলে দাঁড়ায় ‘প্রাণের স্পন্দনে, প্রকৃতির বন্ধনে’। প্রকৃতিতে প্রাণের স্পন্দন তখন স্পন্দিত হবে যখন প্রকৃতিকে তার মতো করে থাকতে দিই আমরা। প্রকৃতির বন্ধনে নিজেকে আবদ্ধ করতে হলে অবশ্যই এসব প্রাণের স্পন্দনকে বাঁচাতে হবে, বিকশিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন প্রকৃতির আলিঙ্গনে নিজেকে সমর্পণ করা। আমরা মানুষ প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতির কোল থেকেই আমরা বেড়ে উঠি এবং বর্তমান সময়ের সভ্য মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছি।। কিন্তু সেই প্রকৃতি থেকে দিন দিন আমরা দূরে চলে যাচ্ছি। আমরা যারা শহরে থাকি প্রকৃতির সাথে আমাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগই নেই। আর আমরা যারা গ্রামে বাস করি আমরাও কেমন জানি দিনকে দিন প্রকৃতি থেকে দূরে সরে দাঁড়াচ্ছি। আমরা প্রতিদিন যে খাবার খাই সেটিও এতো বেশি প্রক্রিয়াজাতকরণ করা যে তাতে প্রকৃতির স্বাদ-গন্ধও বিন্দুমাত্রও নেই। আমাদের গায়ে লাগে না কাঁদা-মাটি; পানিও পান করি বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও রাসায়নিক পদার্থ মেশানো। প্রতিদিন হাজারো তথ্য প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হচ্ছি। কিন্তু প্রকৃতি সম্পর্কে থেকে যাচ্ছি অজ্ঞ। নতুন কোন গাছ চিনি না, ধান চিনি না, মাছ চিনি না। অন্যান্য ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র উদ্ভিদ আর প্রাণীর কথাতো বাদই দিলাম। আমরা কি জানি আমাদের চারপাশে কত ধরনের রঙ-বেরঙের প্রজাপতি আছে? কত ধরনের পাখি আছে? কত ধরনের ঘাস আছে? প্রকৃতি থেকে এই দূরত্ব হয়তো আমাদেরকে আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর এবং প্রযুক্তি নির্ভরশীল করে তুলছে। আর তাই এই পরিবেশ দিবস হতে পারে আমাদের জন্য এক সূবর্ণ সুযোগ প্রকৃতিকে জানার, চেনার বুঝার।
চলুন না আজ বেরিয়ে পড়ি খালি পায়ে। সবুজ ঘাসের বুকে কিছুক্ষণ হাটি। লাগুক পায়ে কাঁদা। চিনে নিই নতুন একটি উদ্ভিদ প্রজাতিকে। চলুন না ঘুরে আসি সবুজের কাছকাছি কোন একটি বাগান কিংবা পার্কে চিনে নিই নতুন ১০টি গাছ, পাখি, পোকা, ফড়িং, প্রজাপতি। কিংবা পরিচিত হই এমন একজন মানুষের সাথে যিনি প্রকৃতির সাথে একীভূত। তার সাথে গল্প করে জেনে নিই প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য। হারিয়ে যাই প্রকৃতির মাঝে, বিলীন হয়ে যাই।
হ্যাঁ, জানি এই একটি দিবস যথেষ্ট নয় প্রকৃতির সাথে একাত্ম হওয়ার জন্য। কিন্তু শুরুটা তো হতে পারে এই দিনেই। সবাইকে পরিবেশ দিবসের ২০১৭ এর শুভেচ্ছা।