টিকিয়ে রাখতে হবে পালা গানের ঐতিহ্য
চাটমোহর,পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
সিট কভার বিহীন ভাঙ্গাচোড়া একটি সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে খালি টিন। লম্বা কাঠের ডাটের ছাতাটি ও রশি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। লাল রঙের গামছায় কিছু একটা বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছেন সাইকেলের হ্যান্ডেলের সাথে । হাফ হাতা শার্ট এবং লুঙ্গি পড়া দীর্ঘদেহী মানুষটি যখন চাটমোহর-পাবনা সড়কের পাশ দিয়ে বেল ব্রেক বিহীন মরিচাপড়া সাইকেল ঠেলে হেটে আসছিলেন ঠিক তখন চিকনাই থিয়েটারের সভাপতি ছালাম ভাই জানালেন ইনিই এক কালের মঞ্চ কাপানো পালা গানের শিল্পী জহুরুল ইসলাম। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে ডাক দিতেই ফিরে তাকালেন। সামনে থেকেই চোখে পরছিল তার পেছনের চুলের বাহার। সন্ধ্যা ছুই ছুই তখন। মূলগ্রাম হাটে গুড় বিক্রি করে ফিরছিলেন এক সময়ের পালা গান গাতক চাটমোহরের মূলগ্রামের জহুরুল বয়াতী। সাইকেলটি রাস্তার পাশের একটি গাছের সাথে ঠেকিয়ে রেখে আমাদের পাশে বসে হারানো দিনের কথা স্মৃতিচারণ করেন তিনি।
জহুরুল ইসলাম বলেন, “গানের প্রতি ছিল নেশা। ছিল ঝোঁক। ছোট বেলায় যেখানে গানের আসর হতো বাবা মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করে ছুটে যেতাম সেখানেই। নিজের মধ্যে একটা ভূবন গড়ার চেষ্টা করি। কিন্তু উপড়ে উঠতে সিঁড়ি থাকা চাই। স্মরণাপন্ন হই ওস্তাদ তোফাজ্জল বয়াতীর। পাবনার টেবুনিয়া এলাকায় বাড়ি ছিল তার। বৈবাহিক সূত্রে কিছুদিন চাটমোহরের মূলগ্রামে ও বসবাস করেন। গান শেখার জন্য তার কাছে পরে থাকতাম দিন রাত। পঁচিশ বছর যাবত গান করি। পালা গান। মাটির গান। মানুষের গান।” তিনি আরও বলেন, “ওস্তাদের সাথে রাজশাহী পাবনা চুয়াডাঙ্গা সিরাজগঞ্জ টাঙ্গাইল নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পালা গান গাইতে যেতাম। দশ বারো বছর ওস্তাদের সান্নিধ্যে থাকার পর ওস্তাদ মৃত্যুবরণ করলে নিজে বিভিন্ন এলাকা গ্রাম গঞ্জে গান শুরু করি। আমার বাবা মৃত আজিজল হক গান বাজনা ভালো চোখে দেখতেন না। বিভিন্ন জায়গায় আমার গানের সুনাম শুনে আমার গান শুনতে আসরে যেতেন।” তিনি বলেন, “বিভিন্ন কারণে পালা গান আজ বিলুপ্তির পথে। এখন কখনো দুই চার মাস পর আবার কখনো ছয় মাস পর গানের জন্য ডাক পাই। এক একটা প্রোগ্রামে পাঁচ ছয় হাজার টাকা পাই। সাথে চারজন বাদক থাকে। ওদের হাজার তিনেক টাকা দেই। আমার আড়াই তিন হাজার টাকা থাকে। চিকনাই থিয়েটার এর সাথে সম্পৃক্ত আছি। কখনো কখনো দলের হয়ে শো করতে হয়। এতে কি দিন চলে? মাস চলে? জীবন জীবিকার তাগিদে তাই গুড়ের ব্যবসা করছি।”
তিনি আরো জানান, আগে মোবাইল ছিলনা। কোথাও হয়তো একটানা সাত রাত গান করে যখন ক্লান্তি অনুভব করতেন বিশ্রাম নেবার জন্য দুই এক দিনের জন্য বাড়িতে আসতেন। অনেক সময় এসে দেখতেন নতুন এলাকায় গানের জন্য বায়না করার জন্য কেউ না কেউ এসে বসে আছে।
এ শিল্পীর এক ছেলে এক মেয়ে। দুজনেই গান করে। চিকনাই উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিবে। দশ শতাংশ বসতবাড়ি ছাড়া জমা জমি নেই তার। দুইটি গরু পালন করেন। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া ও সংসার খরচ বাবদ প্রতিদিন চার জন খানেআলার পেছনে অন্তত চার শত টাকা খরচ তার। গুড় বিক্রি করে কোন মতে সংসারের ঘানি টেনে চলা এ শিল্পী বলেন, “যত দিন পারি পালা গানের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে গান করে যাবো”।
“গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য থাকলো কই? কবি গান, জারি গান, সারি গান, পালা গান এগুলো তো উঠেই যাচ্ছে। ওস্তাদের সাথে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গান গাইতে যেতাম। বাড়ি ঘর ছেড়ে দশ পনেরো দিন করে কাটিয়ে আসতাম বাইরে। কখনো এর চেয়েও বেশি। আগেকার দিনে এক একটি পালায় দুই দলকে হাজার বারশো টাকা দেয়া হতো। একেক দলে গায়েন বাদক দিয়ে পাঁচ ছয় জন করে লোক থাকতো। তখন রাত গেলেই একশ টাকা পেতাম। টাকার দাম ছিল। একশ টাকায় অনেক কিছু হতো। আর এখন? এখন কবি গান, জারী গান, সারি গান, পালা গান এগুলোর প্রচলন উঠেই যাচ্ছে। হঠাৎ কোন জাতীয় দিবস পালনের সময় ডাক পাই। সঙ্গী সাথীদের ও অনেকে মারা গেছেন। সখ এবং গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনো ডাক পাওয়া সাপেক্ষে গান করে যাচ্ছি” জানালেন পাবনার চাটমোহরের হেংলী বুধপাড়া গ্রামের গায়ক ওমর আলী বয়াতী (৭০)।
আলাপকালে জানা যায়, প্রায় ৪৫ বছর যাবত কবি গান, জারি গান, সারি গান, পালা গান করে আসছেন তিনি। প্রথম জীবনে প্রায় দশ বছর আটঘরিয়া থানার হাসাইখালী গ্রামের ওস্তাদ মজির উদ্দিনের সান্নিধ্যে কাটান। পরে বেশ কিছুদিন পাবনার নাজিরপুরের ওস্তাদ দ্বিরুপ সরকারের সান্নিধ্যে কাটান। শহীদ কারবালা, গৌড় মতি জাড়ি, জয়নাল উদ্ধার কেচ্ছা কাহিনী গান করেন তিনি। তিনি বলেন, স্রোতারা গান শুনে যখন আবেগাপ্লুত হতো, চোখের পানি ফেলতো তখন ভালো লাগতো।”
তিন ছেলে পাঁচ মেয়ের জনক এ গায়ক। এর মধ্যে তিন মেয়ে দুই ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন। বিবাহিত ছেলেদের পৃথক সংসার। স্ত্রী এক ছেলে দুই মেয়েসহ পাঁচজন এক অন্নে বসবাস করেন। পৈত্রিক সূত্রে চার বিঘা জমি পেয়েছেন। এখন এগুলো আবাদ বসত করেন তিনি। পাশাপাশি বর্ষাকালে এলাকায় নৌকা বাইচ হলেই সারি গান গাইবার জন্য ডাক পরে ওমর বয়াতীর। চিকনাই থিয়েটারের সাথে যুক্ত ওমর আলী ও অপেক্ষায় থাকেন এসময়টার জন্য। সব মিলিয়ে কোন রকমে দিন কাটছে বলে জানান ওমর বয়াতী।
এ ব্যাপারে চিকনাই থিয়েটারের সভাপতি প্রভাষক আব্দুস ছালাম জানান, পালাগান জারি, সারি গান আজ বিলুপ্তির পথে। পেশায় টিকতে না পেরে পুরাতনেরা পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। সখ করে যারা নতুন এ পেশায় আসছেন তাদের গান তথ্যসমৃদ্ধ নয়। পালা গান করতে হলে জানতে হবে। গানের মাধ্যমে এক দল আরেক দলকে উপস্থিত প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। পর্যাপ্ত জ্ঞান অভিজ্ঞতা না থাকলে তাৎক্ষণিক গানের সুরে ছন্দে প্রতিপক্ষের প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন হয়ে পরে। তখন তারা প্রাসঙ্গিকতা থেকে বাইরে চলে যায়। তবে গ্রাম বাংলার হাজার বছরের এ ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে গায়কদের সূযোগ করে দেয়ার পাশাপাশি সবার সুদৃষ্টি আবশ্যক।