পানির জন্য প্রকৃতি
পাভেল পার্থ
বাংলাদেশ এক জলময় দেশ। ‘নদীমাতৃক ও বন্যাপ্লাবিত’ রূপকল্পগুলো এদেশের খানাখন্দে মিশে আছে। তাহলে এই জলময় দেশের রাষ্ট্র পানি নিয়ে কেমন চিন্তা করে? পানি নিয়ে রাষ্ট্রের দর্শনটাই কী? রাষ্ট্র পানিকে কীভাবে দেখে বা দেখতে চায়? তরতর করে এমনতর কতকত প্রশ্নবিন্দু উপচে পড়ে। খোদ পানি নিয়ে দেশে একটি নীতিমালা ও একটি আইন আছে। জাতীয় পানি নীতি ১৯৯৯ এবং বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩। রাষ্ট্র কেন এই পানি নীতি ও আইন করেছে? রাষ্ট্র তা উল্লেখ করেছে। পানি নীতির লক্ষ্য হলো, পানিখাতে কর্মরত সব সংস্থা ও যেকোনোভাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে উদ্দেশ্য সাধনে দিকনির্দেশিকা দেয়া। তবে পানি আইনের লক্ষ্য ভিন্ন। বলা হয়েছে, পানি সম্পদের সমন্বিত উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা, আহরণ, বিতরণ, ব্যবহার, সুরক্ষা ও সংরক্ষণ সম্পর্কিত বিষয়ে বিধান প্রণয়ন সমীচীন বলে আইনটি করা হয়েছে। পানি নিয়ে তর্ক আজকের নয়, হয়তো এ তর্ক দুনিয়ায় জারি থাকবে। পানির কথা ওঠলেই নানা বুদবুদ তৈরি হয়। পানির উৎস থেকে শুরু করে, পানি ব্যবহার, বিতরণ, ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞান, কারিগরি, সংরক্ষণ, দখল, দূষণ, বিপর্যয়, দূর্যোগ, বাণিজ্য, প্রবেশাধিকার, ক্ষমতা, রাজনীতি কী পানিহীনতা সব নানারেখায় গড়িয়ে পড়ে।
পানি ঘিরে নানা ভাষ্য ও জীবনাচার আছে। এটি প্রতিবেশব্যবস্থার ভিন্নতা থেকে শুরু করে প্রজাতির বৈচিত্র্য এবং আন্তঃপ্রজাতিতেও ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। সাপের সমাজে পানি জরুরি, আবার মানুষের সমাজও কী পানি বিনা ভাবা যায়! তো সাপ তো আর কেবল এক জাতের নয়। চন্দ্রবোড়া, অজগর, লাউডুগী, দাঁড়াশ, গোখরা, শংখিনী, তোতলবোড়া, গুলবাহার, কালনাগিনী নানা জাতের সাপ আছে। সব সাপের জন্য কিন্তু একইভাবে পানি দরকার হয়না। কারো কম, কারো বেশি। কারো দিনে, কারো রাতে। কারো গ্রীষ্মে, কারো বর্ষায়। মানুষেরও তাই। কত জাতের সমাজ মানুষের। একেক সমাজে পানির একেক ব্যবহার। জল ছাড়া জীবন বাঁচে না, আবার এই জলে ডুবেই নানা অভিমানে মানুষ মারা যেতে চায়।
বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষের পানিচিন্তার সাথে রাষ্ট্রের পানিচিন্তার বিস্তর ফারাক আছে। গ্রামীণ মানুষ পানিকে দেখে এক জীবন্ত সত্তা হিসেবে। গ্রাম-বাংলার মানুষ মনে করে পানি জন্ম নেয় এবং বেড়ে ওঠে, একসময় পানির মৃত্যু হয় এবং আবারো পানি নতুন জন্মে ফিরে আসে। দেশের সমতল কী পাহাড়ের মানুষ জলের শরীর আন্দাজ করে। পানির পিঠ, মুখ, নাভি, পেট ও নি¤œাঙ্গ আছে। আর তাই পানিকে ঘিরে পৃষ্ঠতল, উৎসমুখ, কুন্ড, পাতাল এমনকি মিলনস্থল ধারণাগুলো আমাদের ভেতর বহুল চর্চিত। সাধারণ মানুষের এই পানিচিন্তার সাথে রাষ্ট্রের পানিচিন্তার মৌলিক ফারাকটি হলো দর্শনগত। রাষ্ট্রের পানি ভাবনাতে পানি কোনো জীবন্তসত্তা নয়, এর শরীর কী রূপ আন্দাজ করা রাষ্ট্রের লক্ষ্য নয়। রাষ্ট্র মূলত পানিকে দেখে একটা প্রাকৃতিক উপাদান বা সম্পদ হিসেবে। পানি নিয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের এই ভাবনার দূরত্বে সমস্যাটা কোথায়? মূলত সংকটটি তৈরি হয়েছে এই দৃষ্টিভঙ্গিগত দূরত্বের কারণেই। কারণ রাষ্ট্রের এই পানিচিন্তা পানিকে জনগণের পাবলিক-সম্পর্ক থেকে একতরফাভাবে দূরে সরিয়ে এনেছে। পানিকে কেবলমাত্র মানুষের জন্য এক অনিবার্য ভোগ্যপণ্য করে তুলেছে। পানি আজ আর কোনো পাবলিক পরিসরের বিষয় নয়। দুনিয়ার তাবৎ পানিবিন্দুকেই আজ দুঃসহ বহুজাতিক বাণিজ্য কারাগার মেনে নিতে হচ্ছে। দুনিয়ার সব পানীয় জল আজ বহুজাতিক কোম্পানির বোতলে বোতলে বন্দি হয়ে গেছে। তাও কেবল মানুষেরই জন্য। বেঁচে থাকবার অন্যতম শর্ত পানি আজ এক বিলাসী পণ্য। তাহলে একটা গাছ বা পাখি, মাছ কী বাঘ তেষ্টার জলটা পাবে কোথায়? নিশ্চিতভাবে দুনিয়ার সবটা পানিতে কেবলমাত্র মানুষেরই একক এখতিয়ার নাই। গুল্ম, ব্যাঙ, পতঙ্গ, পাখি কী সরীসৃপেরও আছে। জন্ম থেকে জীবনের সকল দশায় পানি আজ বিপন্ন, খন্ডিত, চুরমার। দুনিয়াজুড়ে, সবখানেতেই।
পানির জন্ম নিয়ে গ্রামীণ নি¤œবর্গ কি ভাবে? কেউ বলে পানির জন্ম পাতালে, কেউ বলে পাহাড়ে। কেউ বলে গহীন অরণ্যের জরায়ুতেই জন্ম নেয় জলের ভ্রƒণদানা। দানা দানা জল জমে জমে নানা নামে উজান থেকে ভাটিতে গড়ায়। মানুষের যাপিতজীবনের অভিধানে এই প্রবাহ নানা নাম পায়। কখনো ছড়া, ঝর্ণা, ঝিরি, হ্রদ, পুকুর, দীঘি, ডোবা, নালা, খাল, ভাড়ানি, ঝোরা, হাওর, বিল, বাওড়, খাড়ি, নদী, নদ আবার কখনোবা সমুদ্র। ষাটের দশকের আগে দেশের মানুষ পাতালের পানি খুব একটা দেখেনি। সবুজ বিপ্লবের নামে যন্ত্র দিয়ে পাতালের জল টেনে তোলার কারবার শুরু হল তখনি। সকলের সামনে একটাই পরিসংখ্যান মেলে ধরা হলো যে, খাদ্যশস্য মানে ধানের উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু পাতালপানির এই কারবারে একটা হিসাব সামনে আনা হয় না যেখানে নানা নামের কত কোম্পানির যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক সার-বিষ কিংবা সংহারী বীজের কত মুনাফা হলো। টানতে টানতে আর মাটির বুকে আর রস নেই। আমাদের পাতালভূমি পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। এ তো গেল পাতাল, যদি ভূউপরিস্থ পানির কথায় আসি সেখানে যন্ত্রণা আরো প্রকট। পানি জন্ম নেয় যে পাহাড় কী অরণ্যে সেই পাহাড় ও অরণ্য আজ নিরুদ্দেশ। উন্নয়নের জখমে আমাদের পাহাড় ধসে পড়ে বারবার। দিনে দুপুরে লুট হয়ে যায় অরণ্য-জংগল। এরপরও দারুণ যন্ত্রণা ঠেলে জন্ম নেয়া পানি উজান থেকে ভাটিতে যে গড়িয়ে পড়বে তারও কোনো উপায় নাই। বাঁধ, জলবিদ্যুৎ, অবকাঠামো, দখল কী দূষণে পানির এই প্রবাহ আজ খন্ডবিখন্ড। পানি সভ্যতায় মায়া জাগিয়ে রাখে, সংবেদনশীলতা বিস্তার করে। কিন্তু পানির প্রতি আমরা বরাবরই নির্দয় ও নৃশংস। কোনো মায়া জাগাতে পারিনি, সংবেদনশীলতা বিস্তারে ব্যর্থ হয়েছি।
পানির জন্য সবচে’ জরুরি হলো পানির নিজ প্রকৃতিকে বোঝা এবং পানি যে প্রকৃতিকে ধারণ করে তাকে বোঝা। চলমান পরিবেশবাদী তর্কের ভেতর এর ফায়সালা সম্ভব নয়। প্রাণ ও প্রকৃতির জটিল সম্পর্কের বিজ্ঞান থেকেই একে বুঝতে হবে। একে যাপিতজীবনের চর্চার অংশ করতে হবে। প্রকৃতির প্রশ্নে যেমন পানিকে বোঝা জরুরি, পানির প্রশ্নেও প্রকৃতির নির্ঘন্ট জানাবোঝা জরুরি। চারধারের প্রাকৃতিক পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান, খাদ্যশৃংখল, খাদ্যজাল এবং বহুমাত্রিক প্রতিবেশব্যবস্থাই চলতি আলাপের পানির ভিত্তি, উৎস, বিকাশ, আবাস ও বিচরণস্থল। প্রকৃতির গায়ে সামান্য আঁচড় লাগা মানে পানির শরীরে এর বিরূপ প্রভাব পড়া। একটি বন থেকে কিছু গাছ কাটলে কী হয়? সেখানে পানির জন্ম বাধাগ্রস্ত হয়। রেলপথের নিরাপত্তার দোহাই তুলে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া বনের অনেক গাছ কাটার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিংবা সড়ক উন্নয়নের নামে যশোর রোডের গাছ কাটার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এভাবে অরণ্য কী বৃক্ষস্থল কমে গেলে পানিপ্রবাহ কমে যায়। বান্দরবানের ফারুকপাড়ার বম আদিবাসীরা কয়েকবার তাদের প্রধান বসত পরিবর্তন করেছেন। কারণ আগের বসতিতে বন কমে গিয়েছিল আর সে কারণে ঝর্ণাগুলোও মরে গিয়েছিল। শুধু নদী পথগুলো খুন হয়েছে বলে নদীতে নৌকার বহরে থাকা মাল মাংতা বেদেদের আজ ডাঙায় ওঠে আসতে হয়েছে। এভাবে দেশজুড়ে সহ¯্র অযুত রক্তাক্ত নির্দেশনা আছে। আমরা সকলেই পানি নিয়ে এমনতর নানা ভোগান্তির ভেতরেই টিকে আছি। প্রকৃতি সুরক্ষার প্রশ্নে আমরা নানা গুরুত্বের কথা টানি। পানির অস্তিত্বের সাথে একাকার হয়ে আছে প্রকৃতি সুরক্ষার মৌল শর্ত। প্রকৃতি ও পানির এই যমজ অভিন্ন সত্তাকে সকল তল থেকেই বোঝা জরুরি। রাষ্ট্রকেও এটি বুঝতে হবে। কেবলমাত্র নীতি বা আইনের ভেতর দিয়ে জলের জীবন সুরক্ষিত থাকেনা। এর জন্য রাষ্ট্রের পানিচিন্তায় মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরি। প্রকৃতি বাঁচলে, পানি বাঁচবে এটিই জলজীবনের সহজ ব্যাকরণ। রাষ্ট্রের দায়িত্ব মগজ থেকে সংসদ সর্বত্র এই ব্যাকরণ সমুন্নত রাখা।
জাতিসংঘের সাধারণ সভায় অনুমোদনের পর ১৯৯৩ সনের ২২ মার্চ প্রথম পালিত হয় বিশ্ব পানি দিবস। জাতিসংঘ ঘোষিত প্রতিটি দিবসের মতই পানি দিবসে প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়। ১৯৯৪ সালের প্রতিপাদ্য ছিল, পানি সম্পদ সুরক্ষা সকলের দায়িত্ব। ১৯৯৫ সালে নারী ও পানি, ১৯৯৬ সনে তৃষ্ণার্ত নগরীর জন্য পানি, ১৯৯৭ বৈশ্বিক পানি কি যথেষ্ট, ১৯৯৮ ভূ-গর্ভস্থ পানি অদৃশ্য সম্পদ, ১৯৯৯ সকলেই ভাটিতে, ২০০০ একুশ শতকের জন্য পানি, ২০০১ স্বাস্থ্যের জন্য পানি, ২০০২ উন্নয়নের জন্য পানি, ২০০৩ ভবিষ্যতের পানি, ২০০৪ পানি ও দুর্যোগ, ২০০৫ জীবনের জন্য পানি, ২০০৬ পানি ও সংস্কৃতি, ২০০৭ পানিহীনতা, ২০০৮ পয়ঃনিষ্কাশন, ২০০৯ অভিন্ন জল ও জলের ভাগ, ২০১০ পানির গুণগত মান, ২০১১ নগরের জন্য পানি, ২০১২ পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা, ২০১৪ পানি ও শক্তি, ২০১৫ পানি ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন, ২০১৬ ভালো পানি ভালো কাজ, ২০১৭ কেন বর্জ্যপানি? ২০১৮ সনের প্রতিপাদ্য হলো, পানির জন্য প্রকৃতি। কেবল পানি দিবসই নয়; ২০০৫ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত পানি দশক, ২০০৮ সালকে আন্তর্জাতিক পয়ঃনিষ্কাশন বর্ষ ও ২০১৩ সালকে আন্তর্জাতিক পানি সহযোগিতা বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে।
দেশজুড়েই প্রাণ ও প্রকৃতিতে সংকট চলছে। এর মানে হলো দেশে পানিযন্ত্রণাও চলমান আছে। এই সংকট ও যন্ত্রণা সামাল দেয়া কোনো একক কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তির কাজ নয়। দরকার সামষ্টিক তৎপরতা। জলের জন্য আসমুদ্রহিমাচল জাগরণ। চারধারের প্রকৃতির প্রতি নতজানু হলেই আমরাও টের পাবো পাতাল কী পাহাড়ে পানির অবিরাম গুঞ্জরণ।