সাম্প্রতিক পোস্ট

উপকার ও ঐতিহ্য রক্ষা দুটোই হয়

উপকার ও ঐতিহ্য রক্ষা দুটোই হয়

বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে অমৃত সরকার

ঐতিহ্য কে ভুলে যাবেন না, সঠিক পণ্য চিনে ব্যবহার করুন এ রকম অনেক বিজ্ঞাপন আমরা হর হামেশই বিভিন্ন মাধ্যমে দেখতে পাই। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী পণ্য বা উপকরণগুলো যেভাবে তৈরি হয় তার লেশমাত্র পদ্ধতি এখানে ব্যবহার হয় না, গ্রাম বাংলার কোন ঐতিহ্যবাহী পণ্য যেমন শিতলপাটি, নকশীকাঁথা, শখের হাড়ি বা গ্রাম বাংলার ধান রাখার নানান ধরনের গোলা এগুলো তৈরি করতে একটি পরিবার বা জনগোষ্ঠীর নিপূণ হাতের কাজ,চিন্তা মিলে মিশে তৈরি হয়, ঠিক বিপরীতভাবে বড় বড় কারখানার কলে বিকল্প উপাদান দিয়ে তৈরি হয় গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী পণ্যের মত দেখতে কিছু পণ্য। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে ধান ঝাড়াই করার জন্য প্লাষ্টিকের কুলা, বসতে দেওয়ার মুড়া,বাচ্চাদের দোল খাওয়ার দোলনা। সব থেকে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে এগুলো বাজারজাতকরণের বিজ্ঞাপনে কিন্তু দেখানো হয় চিরাচরিত গ্রাম বাংলার দৃশ্য। বড় বড় কলকারখানায় কখনো ঐতিহ্যকে লালন করা যায় না। ঐতিহ্য লালন হয় গ্রাম বাংলাতেই।

30223402_1724234654304903_335256102_o
প্রতিটি অঞ্চলই আলাদা আলাদা ঐতিহ্যকে লালন করে, তেমনই বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহ্য বলতেই চোখে ভাসে বড় বড় মাটির তৈরি দোতলা, তিনতলা বাড়ি এবং সাংসারিক বিভিন্ন কাজে মাটির তৈরি উপকরণ। ভৌগলিক কারণেই এই এলাকার মানুষ মাটিকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নিয়েছে। এই এলাকার মানুষ মাটি দিয়ে তৈরি করে ধান রাখার গোলা, কুঠি,চাল রাখার চাল কুঠি, হাঁস-মুরগি রাখার খোলা, অতিথিকে বসতে দেওয়ার মোড়া, রাতে গরুকে খাওয়ার দেওয়ার গোড়া, মাটির এক থেকে দুই তলা উঠার সিঁড়ি, রান্না ঘরে রান্না ভাত রাখার জন্য বড়শির মত অনেক উপকরণ। এই সকল জিনিস তৈরি করার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আবার এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের মধ্য ছড়িয়ে যায় আলোচনা ও গল্পের মাধ্যমে। তবে এখন বিভিন্ন প্লাষ্টিকের পণ্য ও উন্নয়নের চাপে পরে মাটির তৈরি উপকরণগুলো আজ বিলীনের পথে।

30176608_1724234507638251_2007519491_o
তবে বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি উপজেলার বটতলী গ্রামের মোছাঃ তানজিলা বেগম (৪০) মায়ের কাছে পাওয়া জ্ঞান নিজের চর্চার মধ্য দিয়ে রক্ষা করে চলেছেন গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। তিনি নিজের অধিকাংশ পারিবারিক কাজেই ব্যবহার করেন মাটির তৈরি উপকরণ। তিনি নিজে মাটি দিয়ে তৈরি করতে পারেন ধান রাখার গোলা, কুঠি, চাল রাখার চাল কুঠি, হাঁস-মুরগি রাখার খোলা, অতিথিকে বসতে দেওয়ার মোড়া, রাতে গরুকে খাওয়ার দেওয়ার গোড়া, মাটির এক থেকে দুই তলা উঠার সিঁড়ি,রান্না ঘরে রান্না ভাত রাখার জন্য বড়শি। তাঁর বাড়ির বিভিন্ন পাশে দেখা যায় মাটির তৈরি বিভিন্ন উপকরণ সাজিয়ে রাখা। এ প্রসঙ্গে মোছা তানজিলা বেগম বলেন, “আমার বয়স যখন ৮-১০ বছর তখন শীতের সময় দেখেছি আমার মা মাটি দিয়ে চার কোনা ও গোলাকৃতির ধান রাখার গোলা তৈরি করতো। আস্তে আস্তে মাটি লাগাতো এবং রোদে শুকাতো, আমি দেখে দেখে এগুলো তৈরি করা শিখেছি। এখন আমি সকল ধরনের জিনিসই নিজে তৈরি করতে পারি। এখন মাটির এগুলো তৈরি করি বলে আমার উপকার হয় পাশাপাশি আমার মায়ের স্মৃতি দুটোই রক্ষা হচ্ছে।” তিনি আক্ষেপ করে আরো বলেন, “এখন কেউ আর এগুলো ব্যবহার করতে চায় না। তবে মাঝে মাঝে এখনও কেউ কেউ ধানের গোলা তৈরি করে নেওয়ার জন্য আসেন আমার কাছে। আমি অবসর সময়ে বিনামূল্যে কাজ করে দিয়ে আসি।”

30232922_1724234700971565_1045260591_o
এ সকল মাটির উপকরন রক্ষণাবেক্ষণ ও উপকার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মাটির এ উপকরণগুলো বছরে একবার নরম মাটি ও ধানের কুড়া দিয়ে লেপে দিলে ১০-১৫ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। মাটির এই গোলাতে ধান বা সেদ্ধ ধান রাখলেও কোন পোকা ধরে না ও গন্ধ হয় না। আবার বীজ ধান রাখলেও ভালো থাকে। মাটি তাপমাত্রা সংরক্ষণ করে বলে বর্ষা মৌসুমেও ধান রাখলে কোন সমস্যা হয় না।”
কিছু মানুষ নিজের কাজের মাধ্যমেই রক্ষা করে চলেন গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ও নিজের পূর্ব প্রজন্মেও জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। আবার এ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা পরের প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে আনন্দ পান। তানজিলা বেগম নিজের কাজের মাধ্যমেই রক্ষা করে চলেছেন এর দুটিই।

happy wheels 2

Comments