শংকরের আনন্দ বেদনার গল্প
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
লাল ফিতার সাথে বাধা বাঁশি মুখে নিয়ে বাজাতে বাজাতে ছুটে চলে শংকর। লাল নিশান লাগানো ইঞ্জিন চালিত লাশের গাড়ি নিয়ে ছুটে চলে সে রাস্তায়। ভীড় হলে তীব্র হয় বাঁশির শব্দও। দিন রাত নেই। যে কোন সময় ছুটতে হয় তাকে। এক দিনে ১১টি পর্যন্ত লাশ নিজের হাতে গাড়িতে তুলে পরিবহনের অভিজ্ঞতা ও রয়েছে তার। সম্প্রতি কথা হয় এ লাশ বাহক শংকরের সাথে। বেরিয়ে আসে তার জীবনের গল্প। যে জীবন ভরে আছে সুখ দুঃখ হাসি কান্না আনন্দ আর বেদনায়।
পুরো নাম শ্রী শংকর সরদার। তবে সবাই তাকে শংকর নামেই চেনে। বয়স ৫৫ বছর। পিতার নাম মৃত সুরেশ সরদার। বসবাস করছেন চাটমোহর পৌর সদরের কাজী পাড়া মহল্লায়। আদিবাসী পঞ্চাশোর্ধ এ ব্যক্তি ডোমের কাজ করেন। লাশ বহন করেন। কখনো কখনো লাশ কাটাছেড়ার কাজ ও করতে হয় তাকে। এ পেশায় আছেন প্রায় দুই যুগ।
শংকর বলেন, “পাকিস্তান আমলে আমার বাবা সুরেশ সরদার সাবেক চাটমোহর ইউনিয়নের চকিদার ছিলেন। তিন ভাই এক বোন আমরা। এক বোন মারা গেছে অনেক বছর আগে। আফ্রাত পাড়া স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি। আর পড়া হয়নি। দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে বাবা মায়ের সাথে ভারতে চলে যাই। বছর খানেক ভারতে থাকার পর দেশ স্বাধীন হলে দেশে ফিরে আসি। ভারতে অবস্থান কালেই বাবা মারা যান। আমার বড় ভাই সুবোধ সরদারের বয়স তখন আট কি নয় বছর। একই ক্লাসে পড়তাম দুই ভাই। ছোট ভাই সুন্দর সরদার তখন কোলের শিশু। ছোট বোনটি ও তখন খুব ছোট।” তিনি আরও বলেন, “বাবা বেঁচে থাকতেই বড় বোনটিকে বিয়ে দিয়ে যান। আমরা তিন ভাই মা ও ছোট বোন এ পাঁচ জনের সংসার চালাতে মা সত্যবালা সরদার অন্যের বাড়িতে ঝি এর কাজ নেন। আমরা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকি। কর্মক্ষম হতে না হতেই বড় ভাই ও আমি রিকশা চালানোর কাজ শুরু করি। বাইশ তেইশ বছর আগে চাটমোহর থানার লাশ বহনকারী একটি দূর্ঘটনার শিকার হয়ে হাত পা ভেঙ্গে গেলে আমি থানার লাশ বহনের কাজে যোগ দেই। সেই থেকে এখনো লাশ বহন করে আসছি। যখন লাশ বহনের কাজ থাকে না তখন থানার স্যারদের মোটরসাইকেল ধুয়ে মুছে দেই। স্যাররা খুশী হয়ে কিছু টাকা পয়সা দেন।”
শংকর বলেন, “এক ছেলে এক মেয়ে আমার। ছেলেটি বড়। নাম সুনীল সরদার। আমি ওকে পড়ালেখা করানোর চেষ্টা করলেও ও পড়ালেখা করেনি। এখন রিক্সা চালায়। মেয়ে সোনেকার বয়স আঠারো বছর। পড়া লেখা করে না। স্ত্রীসহ চারজনের পরিবারের ভরণ পোষণ করতে হয় আমাকে। ছেলে দিনে দেড় দুই’শ টাকা কামাই করে।” তিনি বলেন, “চাটমোহর থানা এলাকায় যখন কোথাও অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটে থানা থেকে ফোন পাই। ফোন পেলেই সে লাশ বহন করতে ছুটতে হয় আমাকে। ঘটনাস্থল থেকে লাশ নিয়ে প্রথমে থানায় যাই। পরে সেটি মর্গে নিয়ে যাই। প্রতিটি লাশ বহন করে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা পাই। স্বাভাবিকভাবে মাসে দুই তিনটি আবার কখনো এর চেয়ে বেশি লাশও বহন করতে হয় আমাকে। প্রথম প্রথম লাশ বহন করতে ভয় করতো। এখন করে না। যখন কোন মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে রওনা হই তখন সেখানে কান্নার রোল পরে যায়। পাড়া প্রতিবেশি আত্মীয় স্বজন দেখার জন্য ভিড় জমায়।”
আবাসস্থল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শংকর বলেন, “পাকিস্তান প্রিয়ডে রবি পোদ্দার নামক এক ব্যক্তি থাকার জন্য দশ শতক জমি দেয়। ভাই বোন সবাই এখনো সেখানেই আছি। দশ পনেরো ঘর আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে বসবাস করছি। নিজেদের কোন জায়গা জমি নাই। আমি দেড় শতকের উপর ঘর বাড়ি করে আছি। প্রতিদিন চার শতাধিক টাকা সংসার খরচ। বসবাসের জন্য নিজস্ব এক খন্ড জমি দরকার। কিন্তুু যে আয় করি তা দিয়ে জায়গা জমি কেনা সম্ভব নয়। কোন মতে খেয়ে পরে দিন যায়। কি করে জায়গা জমি করবো?” তিনি ঋণ পান না। তিনি মনে করেন, সরকার যদি বসবাসের জন্য একখন্ড জায়গা জমি দিত তাহলে খুব ভালো হতো। পচা দূর্গন্ধযুক্ত লাশ তোলার সময় লাশের পরিবারের পক্ষ থেকে কিছু বেশি টাকা দেয়। সরকারিভাবে কোন টাকা পয়সা পান না। পনেরো ষোল বছর আগে তিনি চাটমোহরসহ পার্শ্ববতী ভাঙ্গুড়া ও আটঘরিয়া থানার লাশ ও টানতেন। এক দিনে এগারোটি পর্যন্ত লাশ ও বহন করতে হয়েছে তাঁকে।