পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চাকারী আবুল কালাম মিয়া

পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চাকারী আবুল কালাম মিয়া

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
সবুজ শ্যামল ছায়া ঘেরা কেন্দুয়া উপজেলার একটি গ্রামের নাম আশুজিয়া। এই গ্রামেই পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চাকারী কৃষক আবুল কালাম মিয়া। ৬ সদস্য বিশিষ্ট পরিবার কৃষক আবুল কালামের। এক কৃষক পরিবারের ছেলে হওয়ায় ছোট বেলা থেকেই বাবার সাথে জমিতে কাজ করতেন আগ্রহের সাথে। জমি প্রস্তুত, ধান রোপণ, ধান কাটা, ধান তোলা, সবজি রোপণ, মাঁচা তৈরি, যত্ন নেয়া সবই শিখেছেন বাবার হাত ধরে। গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করার পর আর্থিক অস্বচ্ছলতার জন্য তার আর পড়াশুনা করা হয়নি। পরিবারের হাল ধরতে তিনি মনোযোগ দেন কৃষিকাজে। সংসারের দায়ভার বহনের পাশাপাশি ছোট ভাই-বোনদের লেখাপড়ার দায়ভার তার কাঁধে ন্যাস্ত হবার পর তিনি পুরোদস্তর কৃষক বনে যান।

Abul Kalam Miah

আবুল কালাম মিয়ার মোট নিজস্ব জমির পরিমাণ ১২০ শতাংশ (এক একর বিশ শতাংশ)। সারাবছর জমিতে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে মৌসুমভিত্তিক শস্য ফসল চাষাবাদ করেন। এলাকা উপযোগি ধানের জাত নির্বাচন ও ভালো বীজ সংরক্ষণের জন্য তিনি নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন ধানের জাত নিয়ে গবেষণা করেন। মাঠ দিবস আয়োজন করে তিনি গবেষণার ফলাফল বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের সাথে সহভাগিতা করেন। বিগত দুই বছরে গবেষণার মাধ্যমে নির্বাচিত এলাকা উপযোগি ধানের জাত (আমন মৌসুমের) নিজ গ্রামের ২০ জন কৃষককে, ভূগিয়া রামপুর গ্রামের ২জন কৃষককে স্থানীয় তিন জাতের ধান বীজ (মালশিরা, ঋতুপাইজাম ও সুবাস ধান) এবং নগুয়া গ্রামের কৃষক বীজ ঘরে ৫টি স্থানীয় জাতের ধানের বীজ দিয়েছেন। আবুল কালাম মিয়া প্রতি মৌসুমে বীজ সংরক্ষণ করে এবং মরিচের চারা ও বেগুনের চারা কৃষকদের সাথে বিনিময় করেন।

জৈব সার তৈরি
কৃষক আবুল কালাম মিয়া জৈব উপায়ে সবজি চাষ করার লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে মাটির চাড়িতে কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদন আরম্ভ করেন। শুরুতে তিন ধারনের কেঁচো দিয়ে তিনি পরীক্ষামূলক জৈব সার উৎপাদন করে সবজি ক্ষেতে ব্যবহার করেন। কেঁচো সার সবজি ক্ষেতে ব্যবহারের ফলে ভালো ফলন হয় এবং পোকা মাকড়ের আক্রমণও কম হয়। এছাড়াও জৈব উপায়ে সবজি চাষের জন্য তাঁকে বাজার থেকে কোন সার কেনার প্রয়োজন হয়নি। প্রতি মৌসুমে তিনি সবজির জাত বৃদ্ধি করায় জৈব সার বেশি করে উৎপাদনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সবজির জমিতে জৈব সার ব্যবহারের পাশাপাশি বীজতলাসহ অন্যান্য শস্যের জমিতেও তিনি কেঁচো সার ব্যবহার করছেন। কেঁচোর সার ছাড়াও তিনি সবুজ সার, তরল সার ও পঁচা আবর্জনা দিয়ে কম্পোস্ট সার তৈরি করে জমিতে ব্যবহার করছেন।

জৈব বালাই তৈরি
জৈব সার তৈরির ন্যয় জৈব বালাইনাশক তৈরিতেও আবুল কালাম মিয়া সমান দক্ষ। তিনি তার উৎপাদিত সবজি ও অন্যান্য ফসলের রোগ-বালাই দমনে ব্যবহার করেন জৈব বালাইনাশক দিয়ে। নিম পাতা, ত্রগরা পাতা (বিষকাটালি), কোরোসিন, সাবানের গুড়া ও বিভিন্ন ধরণের ভেষজ উপকরণ ব্যবহার করে জৈব বালাইনাশক তৈরি করেন। তিনি গ্রামের অন্যান্য কৃষকদেরকে জৈব উপায়ে সবজিসহ শস্য ফসল চাষ করে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

বীজ সংরক্ষণ
ফসল ও সবজি চাষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বীজ। রোগমুক্ত ভালো ও উন্নত বীজ থেকেই ভালো ফসল উৎপাদন সম্ভব। কৃষক আবুল কালাম মিয়া সঠিক সময়ে ফসল চাষ করে সঠিক পদ্ধতিতে বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন। তিনি দুই জাতের শস্যবীজ, ১০ জাতের সবজি বীজ ও ১৫ জাতের ধানবীজ সংরক্ষণ করেন এবং এসব ধান চাষ করে নিজ গ্রাম ও অন্য গ্রামের কৃষকদের মধ্যে ধান ও সবজি বীজ বিতরণ করে থাকেন। তিনি গ্রামের লোকজনদেরকে আগ্রাসী গাছ রোপণ, রাক্ষসী মাছ চাষ এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে ও সাংগঠনিকভাবে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ এবং বৃক্ষরোপণে জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধকরণে বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকেন।

কৃষকদের সহযোগী
কৃষক আবুল কালাম মিয়া কৃষি বিষয়ে এসব দক্ষতা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। নিজ গ্রামের কৃষকদের তিনি জৈব সার তৈরি ও ব্যবহারের জন্য উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। তার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে আশুজিয়া গ্রামের ১৫ জন কৃষক তাদের পতিত জমিতে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তাঁর উৎসাহে গ্রামের ৮ জন কৃষক বিগত মৌসুমে প্রথমবারের মত পতিত জমিতে সরিষা চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। কৃষকরা কম খরচে ও বিনা চাষে হয় এমন শস্য গম, সরিষা ও তিল চাষ করছেন। বৈচিত্র্যময় ফসল চাষের ক্ষেত্রে এলাকার কৃষকরা যে কোন সহযোগিতার জন্য আবুল কালাম মিয়ার কাছে যায় এবং তিনি সাধ্যমত তাদের সহযোগিতা করে থাকেন। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হলে তিনি সম্পদ ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত থেকে কৃষকদের সহযোগিতা করেন।

AbulKalam 2

কৃষক আবুল কালাম মিয়া আশুজিয়া গ্রামের একজন পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চাকারী। তিনি তার গ্রামকে প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন। সকল কৃষককে তিনি পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চায় যুক্ত করার অঙ্গীকার করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় নেত্রকোনা জন সংগঠনে যুক্ত জৈব চর্চাকারী কৃষকদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি অর্গানিক কৃষক ক্লাব নামে একটি কৃষক কমিটি। কৃষক আবুল কালাম সেই কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এভাবেই আবুল কারাম হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছে তার স্বপ্ন পূরণের পথে। “নিজে পরিবেশ বাঁচাব ও অন্যদেরকেও পরিবেশ সংরক্ষণে উৎসাহিত করব” এই প্রত্যয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন কৃসক আবুল কালাম মিয়া। তাঁর মত অন্য সকল কৃষক পরিবেশবান্ধব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে এগিয়ে আসলে জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ খাদ্য ও বৈচিত্র্যময় খাদ্য যেমন সুনিশ্চিত হবে, তেমনি পরিবেশ থাকবে দূষণমুক্ত এবং বৃদ্ধি পাবে কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য।

happy wheels 2

Comments