সাম্প্রতিক পোস্ট

ভাষা আন্দোলনে গৌরব গাঁথা মানিকগঞ্জ

ভাষা আন্দোলনে গৌরব গাঁথা মানিকগঞ্জ

মানিকগঞ্জ থেকে এম.আর.লিটন

মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে দেশব্যাপী যে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে ওঠে, তার প্রভাব রাজাধানী ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে পশ্চিম মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলাধীন তেরশ্রী অঞ্চলে। এই ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে এখন অজানা। ভাষাসৈনিক  ও ভাষা শহীদদের সম্মান জানাতে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতায় কবি  আহ্বান করেছে –হে নতুন প্রজন্ম!/ভুলে যেয়ো না সেইসব কিশোরের কথা/যারা একদিন কচি গলায়/ বাংলাদেশের সব শহরের রাস্তায় রাস্তায়/ অজস্র কৃষ্ণচূড়া আর পলাশ ফুলের গন্ধে/ফুটিয়ে তুলেছিল আরেক রকম রক্ত-লাল-ফুল;/ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!’

ঢাকার অদূরে মহকুমা শহর মানিকগঞ্জে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে গঠিত হয় মাতৃভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৪৮ হতে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত উক্ত সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে আন্দোলন চলতে থাকে। মূলত মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর থানার তেরশ্রীতে এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তেরশ্রী কে. এন. ইনস্টিটিউশনের সহকারী প্রধান শিক্ষক প্রমথ নাথ নন্দী এই আন্দোলন সংগঠিত করতে থাকেন। প্রমথ নাথ নন্দীর সাথে যুক্ত হন একই বিদ্যালয়ের ক্রীড়াবিষয়ক শিক্ষক আফছার উদ্দিন আহম্মেদ। এদের দু’জনের প্রেরণায় আন্দোলন ক্রমশঃ বেগবান হতে থাকে। মানিকগঞ্জে মাতৃভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ এর ব্যানারে ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকে প্রগতিশীল ছাত্র ও ব্যক্তিগণ।

সে সময়ে মানিকগঞ্জ জেলা কেন্দ্রিক ভাষা আন্দোলনের ব্যানারে যারা অংশগ্রহণ করে তারা হলেন- যথাক্রমে তেরশ্রী কে এন ইনষ্টিটিউশনের সহকারী প্রধান শিক্ষক প্রমথ নাথ নন্দী, ক্রীড়া শিক্ষক আফছার উদ্দিন আহম্মেদ, কলেজ শিক্ষার্থী প্রমথ নাথ সরকার, ডা. মোবারক আলী, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ডা. আব্দুল সালাম। তেরশ্রী কে এন ইনস্টিটিউশনের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী আব্দুল হাকিম, আব্দুর রহমান ঠাকুর, মনিন্দ্র নাথ সরকার, সিরাজ উদ্দিন মৃধা, নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিরান উদ্দিন, মো. ওয়াজ উদ্দিন, মো.রেহাজ উদ্দিন প্রমুখ। মানিকগঞ্জ সদরের যারা ছিলেন তারা হলেন- ডা.সামসুর রহমান, আনোয়ার আলী চৌধুরী, ওয়ারেশ উদ্দিন পাশা, জাফর আলম চৌধুরী, খন্দকার দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ। উল্লিখিত আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকার হুলিয়া জারি করে। সকল আন্দোলনকারী গ্রেফতার এড়িয়ে গোপনে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারপরেও পাকিস্তান প্রশাসক কড়া নজরদারিতে রাখে আন্দোলনকারীদের। আর এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে হঠাৎ করে তেরশ্রী কে, এন, ইনস্টিটিউশনের চার শিক্ষার্থীকে গ্রেফতারের মধ্যে দিয়ে।

liton

১৯৪৮ সাল থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে তীব্রতা পায়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ছাত্র জনতার মিছিলে পুলিশ কোনো সতর্কাবস্থা ঘোষণা ছাড়াই গুলিবর্ষণ করলে মানিকগঞ্জের রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা আন্দোলনকারী শহীদ হন। শহীদ রফিক উদ্দিনের মাথার পিছনে গুলি লাগে এবং মাথার পিছনের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ উড়ে যায়। শহীদ রফিক সিংগাইর উপজেলার বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাস করেন এবং মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ থেকে আই, কম পাস করে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্ত্তি হন। ২১ ফেব্রুয়ারির ঢাকার মিছিলে মানিকগঞ্জের খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, আ.সালাম, মীর আবুর খায়ের (ঘটু) উপস্থিত ছিলেন। খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র ছিলেন, আ.সালাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। ঢাকার মিছিলে গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তীব্র গণজাগরণ গড়ে উঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ঘিওরের তেরশ্রী স্কুল মাঠে, মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজ মাঠে হাইস্কুল সংলগ্ন স্থানে, সিংগাইরের চারিগ্রামে গণপ্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মানিকগঞ্জে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যাঁরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে প্রমথ নন্দী, মুনীন্দ্র নাথ ভট্ট্যাচার্য, অরুণ রায় উকিল, প্রিয়নাথ সরকার, নিখিল রঞ্জন ভট্ট্যাচার্য (দক্ষিণাবাবু), সমবায় পরিদর্শক সৈয়দ আনোয়ার আলী চৌধুরী, ডা.সামসুর রহমান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

বিপ্লবী প্রমথ নন্দী বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানালে ১৯৪৮ সালে তেরশ্রীতে এক ছাত্র জনতার সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে ছাত্র জনতার এক বিরাট মিছিল ঘিওরসহ বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে। ১৯৪৯ সনের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি পুলিশ প্রশাসন তেরশ্রী কে এন ইনস্টিটিউশন থেকে যাদেরকে ভাষা আন্দোলের দায়ে গ্রেফতার করে তারা হলেন যথাক্রমে মো. ওয়াজ উদ্দিন, মো. রেহাজ উদ্দিন, ভূপেন্দ্র নাথ দাশ (হাসী), মনিন্দ্র নাথ সরকার। উক্ত আন্দোলনে ডা. শামসুর রহমানের ভগ্নিপতি নাম না জানা আরও একজন অংশগ্রহণকারী ছিলেন।

‘১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির পর ভাষা শহীদদের স্মরণে মানিকগঞ্জের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢাকার অনুরূপ শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। কিন্তু সরকারি কর্তৃপক্ষ পুলিশের সহায়তায় সবগুলো শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ নির্মাণে কর্তৃপক্ষের বাধার কারণে ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অ্যাডভোকেট আ. লতিফ বিশ্বাসের বাসার সামনে শহীদ মিনার তৈরি করে। ১৯৫২ সাল থেকে অদ্যাবধি ঐ শহীদ মিনারটি মানিকগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে টিকে আছে’।

দুঃখজনক হলেও সত্য, উল্লিখিত ভাষা সৈনিকদের সংগ্রামী কার্যকলাপের উপর মানিকগঞ্জ জেলায় পৃথক কোন স্মৃতি চিহ্ন নেই। এমনকি সবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও নেই। ভাষা আন্দোলনে গৌরব গাঁথা স্বপ্ন, তেরশ্রী হাইস্কুল ও কলেজের শিক্ষক প্রমথ নাথ নন্দী ও অন্যান্য সহযোগী আন্দোলনকারীদের স্মৃতির উদ্দেশ্য অবশ্য রাষ্ট্রের এমন কিছু করা উচিত। যাতে করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভাষাসৈনিকদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে পারে।

 

 

happy wheels 2

Comments