কৃষক পেনশন এখন শুধু সময়ের দাবি
মানিকগঞ্জ থেকে বাহাউদ্দিন বাহার
বয়স্ক বা প্রবীণ কৃষকদের তাদের দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অবদানের স্বীকৃতি এবং পেনশন এর দাবি নিয়ে সম্প্রতি মানিকগঞ্জের প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে হয়ে গেল মত বিনিময় সভা। মত বিনিময় সভায় মানিকগঞ্জ জেলার ৬টি উপজেলার সাধারণ কৃষক-কৃষাণী এবং বিভিন্ন কৃষক সমিতির সদস্য এবং নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সভার শুরুতে বারসিক পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বারসিক মানিকগঞ্জ রিসোর্স সেন্টারের আঞ্চলিক সমন্বয়কারি বিমল রায়। তার বক্তব্যে এই দাবির প্রেক্ষাপট এবং যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদনে সম্পূর্ণ অবদান সরাসরি কৃষকের। কিন্তু কৃষক তার উৎপাদিত পন্যের ন্যায্য দাম পায় না। সে সবসময় বঞ্চিত হয়, কৃষি পেশাকে মর্যাদা দেবার ক্ষেত্রে আমাদের সরকারি-বেসরকারী পর্যায়ে অনেক সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। একজন কৃষককে চাকুরির জন্য অন্যের কাছে যেতে হয়। তার নিজের কর্মসংস্থান এবং আরো অনেকের কর্মসংস্থান করে।
কর্মক্ষমতা হারানোর ফলে কৃষি উৎপাদক কৃষকেরই খাদ্যাভাব শুরু হয়। তাকে খাদ্যের জন্য অন্যের দ্বারস্থ হতে হয়। স্বয়ং কৃষকই তার খাদ্যের স্বাধীনতা হারান। খাদ্য উৎপাদকই যখন খাদ্য প্রাপ্তিতে শংকাগ্রস্ত হন; তখন নতুন নতুন খাদ্য উৎপাদক তৈরিতে বাঁধাগ্রস্ত হয়। কৃষক কৃষি কাজের প্রতি আগ্রহ হারান। নতুন নতুন কৃষক তৈরি না হয়ে কৃষক সন্তান বিকল্প কর্মসংস্থানে চলে যেতে থাকে। কৃষি ব্যবস্থায় এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করে। বাণিজ্যিক কৃষিতে মানুষ ধাবিত হয়। ফলে কৃষিতে আর কৃষকের নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। পুরো ব্যবস্থায় একজন কৃষক ক্রমাগত কৃষি থেকে দূরে চলে যাচ্ছে এবং একই সাথে বঞ্চিত হচ্ছে সকল ক্ষেত্র থেকে।
মানিকগঞ্জ এর কৃষক সমাজের পক্ষ হতে আমাদের আহবান বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদনে যে কোন প্রতিকুলতার মধ্যেও কৃষকের সক্রিয় ভূমিকা থাকায় প্রবীণ কৃষকের খাদ্য ও চিকিৎসা নিরাপত্তার লক্ষ্যে তার প্রবীণ অবস্থায় রাষ্ট্রকর্তৃক স্বীকৃতি হিসেবে ‘কৃষক পেনশন’ চালু করা অতি জরুরি’।
আলোচক এর বক্তব্যে বারসিক এর নির্বাহী পরিচালক সুকান্ত সেন জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষকের অবদান থাকা স্বত্বেও কীভাবে প্রতি পদে পদে প্রতারিত হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে সে বিষয়ে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, “সরকার যেমন কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়, ঠিক তেমনি একজন কৃষকও ভর্তুকি দেন।” তিনি বলেন, “একজন কৃষক তার ফসলের উৎপাদন মুল্য এবং বিক্রয়মুল্যের ক্ষেত্রে প্রতিমণে প্রায় ২০০ টাকা ভর্তুকি দেয়। সে হিসেবে রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি ভর্তুকি দেন একজন কৃষক। কিন্তু তার এই অবদানের যেমন কোন প্রতিদান দান দূরে থাক স্বীকৃতিও নেই!
অন্যদিকে বাণিজ্যিক কৃষির ফলে কৃষক প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছে। উদাহরণ হিসবে তিনি বলেন, “একজন কৃষক উৎপাদন করেন ২৮ জাতের ধান। এই চালের বাজারমূল্য ২৫-৩৫ টাকা। কিন্তু এই চালই মধ্যস্বত্ব ভোগীরা মেশিনে কেটে মিনিকেট নাম দিয়ে বিক্রি করছে; আর জার বাজার মূল্য ৪০-৫০ টাকা। কিন্তু এরা কোনভাবেই উৎপাদক নয়; কিন্তুই তারাই লাভবান হচ্ছে। একই সাথে প্রতারিত হচ্ছে তাদের উৎপাদিত ২৮ ধানের নাম থাকছে না হয়ে যাচ্ছে মিনিকেট। আমরা ভোক্তা শ্রেণীও হচ্ছি প্রতারিত।
সুকান্ত সেন তাঁর আলোচনায় বলেন, নতুন প্রজন্ম যেমন কৃষক হিসেবে পেশাকে বেছে নিচ্ছে না; তেমনি বয়স্ক কৃষকরা বাধ্য হচ্ছেন দীর্ঘ দিন ধরে কৃষি কাজকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ২০ বছর আগে যেখানে কৃষকদের গড় বয়স ছিল ৬০ থেকে ৬৩ বছর। বর্তমানে এখন সেটি ৭৫-এ গিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবীণ হিসেবে একদিকে যেমন রয়েছে বার্ধ্যকের শারীরিক-মানসিক কষ্ট। সেখানে আবার বাড়তি খাদ্যের চাহিদা চাপিয়ে দিচ্ছি। আমাদের খাবারের নিশ্চয়তা চাপিয়ে দিচ্ছি এই সমস্ত প্রবীণ কৃষকদের। তিনি বলেন, “তাই এই কৃষকদের জন্য কৃষক পেনশন এখন সময়ের দাবি। সরকার যে প্রবীণ ভাতা দেয় সেটা যেমন সকল কৃষক পায় না। ঠিক তেমনি সেটি যথেষ্টও নয়। প্রবীণদের এক মাসের ওষুধের খরচই হয় না। তাই কৃষকদের স্বীকৃতির জন্য আমরা কৃষকদের পেনশনের দাবটাকে জাতীয়ভাবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছি।”
অন্যদিকে এ্যডভোকেট আজহারুল ইসলাম আরজু বলেন, “কৃষকরাও যে তাদের উৎপাদিত শস্যে ভর্তুকি দেয় সেটি যেমন সরকার জানায় না। তেমনি কৃষকরা নিজেরাও জানে না। অন্যদিকে সরকার যে সমস্ত ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয় সেটি সরাসরি কৃষকের কাজে আসে না। সরকার ভর্তুকি দেয় সার, বিষ, তেল এবং ট্রাক্টরে। এগুলো তো কৃষকের লাভবান করে বরং গ্রামে এক ধরণের ব্যবসায়ীদের সৃষ্টি করছে। গ্রামে গ্রামে কলের লাঙলের ব্যবসায়ী, পানি, বীজ, বিষ, তেল সব কিছুর ব্যবসয়ী আছে। কৃষকদের এই সব কিছু এই সমস্ত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনতে হয়। আমরা দাবি করছি না যে সব কৃষককে একসাথে এই পেনশন দিতে হবে। কিন্তু সীমিত আকারে হলেও শুরু করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।”
তিনি বলেন, “এই দাবির জন্য একটি সার্বজনীন কমিটি করতে হবে-আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য। প্রথমে জেলা পর্যায়ে এই ধরনের দাবি তুলে ঢাকা পর্যায়ে একটি কনভেনশন করতে হবে। জাতীয়ভাবে একটি আন্দোলন কমিটি করতে হবে। কৃষক পেনশন এখন শুধু সময়ের দাবি।” মানিকগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব চক্রবর্তী বলেন, “কোন দাবিই অযৌক্তিক নয়। এখনকার সবকিছুই আন্দোলন সংগ্রামের ফল। অনেকেই বলতে পারেন-কৃষকদের জন্য আবার পেনশন কেন? একসময় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা প্রভৃতি ছিল হাস্যকর। কিন্তু এখন তো সব স্বাভাবিক। একসময় কৃষকদের পেনশনও স্বাভাবিক হিসেবে মনে হবে। সাংবাদিক হিসেবে এই দাবির সাথে একাত্মতা জানাচ্ছি।
কৃষক নেতা সেতোয়ার হোসেন বলেন, “পাফাটা মেহনতি কৃষকের কিছু নেই। আমরা কৃষকরা বিপদে পড়েছি। কৃষক পেনশন অত্যন্ত জরুরি। সরকার কি করবে জানি না। তবে আমাদের এই অধিকার আদায়ের জন্য জোট বাঁধতে হবে।
রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্ত প্রবীণ কৃষক শরীফ আলী বলেন, “মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি সার, বীজ, কীটনাশকসহ সবকিছুতে দখল করে আমাদের পরনির্ভরশীল করে তুলছে। কাঠের লাঙলের জায়গা দখল করেছে ইঞ্জিন লাঙ্গল। কৃষি ক্ষেত্রে নেই কোন ব্যবস্থাপনা। আমরা যারা কৃষক তারা আজ হযবরল অবস্থাতে আছি। ৬০ বছর পরে আমাদের যখন কর্মসংস্থান থাকবে না-তখন আমদের কি হবে? তাই কৃষক পেনশন প্রথা অবশ্যই চালু হওয়া দরকার।
কৃষক নেতা দুলাল বলেন, “কৃষক পেনশন এর দাবি কিছুটা ব্যতিক্রম লাগলেও; এটি এখন সময়ের দাবি। সারা দেশে নিয়মিত ও অনিয়মিত কৃষক আছে প্রায় ৬ কোটি। বিপরীতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে মাত্র ১২ লাখ। ৬ কোটি মানুষের স্বার্থ বিবেচনা না করে সরকার ১২ লাখকে বড় করে দেখছে। কৃষকের পেনশনের জন্য বাজেটে কৃষি ক্ষেত্রে বেশি বরাদ্দ করতে হবে। কৃষকের পেনশন দাবিকে জোরদার করার জন্য হাট বাজার, গ্রাম সভায় প্রচারণা চালিয়ে আরো মানুষকে সচেতন করতে হবে।”
কৃষাণী সাফিয়া বেগম বলেন, “যখনই কোন সুবিধা আসে সেটি কেউ পায়, কেউ পায় না। সবাই যেন পায় সে বিষয়ে সরকারকে দেখতে হবে। সরকারের কাছেই একটাই দাবি কৃষকদের যেন মূল্যায়ন করে, দাম দেয়।”
কৃষক আব্দুস ছালাম বলেন, “গরিব বয়স্করা বয়স্ক ভাতা পায়। কিন্তু সকল কৃষক সেই ভাতার আওতায় আসে না। তাই কৃষকদের পেনশন আমাদের জন্য খুব জরুরি। একজন চাকরিজীবী ২০-৩০ বছর কাজ করলেই পেনশন পায়। কিন্তু আমরা ৪০-৫০ বছর ধরে এত কিছু করলাম। কিন্তু আমাদের (পেনশন) কই? আমরা সকল গ্রামের কৃষকরা যদি একসাথে কথা বলতে পারি তাহলে আমাদের এই দাবী সরকারের কাছে পৌঁছাতে পারবো।”
আলোচক মোসলেমউদ্দিন বলেন, “আমাদের সবকিছু আজকে না হয়ে কালকে হলেও চলে। কিন্তু খাদ্য না হলে চলে না। আর এই খাদ্য যারা যোগান দেয় সেই কৃষক একটা বয়সের পরে তার নিজেরই খাদ্য থাকে না। তাই প্রবীণ কৃষকদের জন্য আমরা কৃষক পেনশন দাবি করছি। আমরা আমাদের টাকা থেকেই আমাদের পেনশন দাবি করছি। আমরা প্রতিদিন জিনিস কিনে যে ভ্যাট ও ট্যাক্স দেই সেখান থেকে সঞ্চিত অর্থ থেকেই-কৃষক পেনশন চাচ্ছি।
কৃষক লীগ এর সদস্য সচিব জাগীর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ বলেন, বয়স্ক ভাতা আছে কিন্তু কৃষক হিসেবে আলাদা কোন ভাতা নেই। ৬০ বছরেই ভাতা দিতে হবে এমন কোন দাবি আমরা করছি না। ৬০ বছরে না দেন ৭০ বা ৭৫ দেন। পদক্ষেপটা ভালো, সফল হলেও আরো ভালো।