একজন গ্রাম পুলিশের সংগ্রামী জীবন
রাজশাহী থেকে মো. জাহিদ আলী
“সংসারে খরচ বেশি। কম টাকার বেতনে চাকরি করি। তাই সারাবছর কষ্ট করেই কাটাতে হয়। এই কষ্ট করে যাচ্ছি ২৮ বছর ধরেই।” উপরোক্ত কথাগুলো বলছিলেন গ্রাম পুলিশ মো. সৈয়দ আলী (৪৫)। থাকেন নওগার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের চৌজা গ্রামে। সৈয়দ আলীর পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। তাঁর স্ত্রী বাড়ির কাজ করেন, বড় ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের পডাশোনা করে। ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে; এখন রেজাল্টের অপেক্ষায় বাড়িতে আছে। অন্যদিকে ছোট ছেলে এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। সৈয়দ আলীর নিজস্ব সম্পত্তি বলতে বসতভিটার ৫ কাঠা জমি এবং ১.৫ বিঘা ধানী জমি আছে যেখান থেকে ৬ মাসের ভাতের যোগান আসে। তাঁর স্ত্রী সারাবছর হাঁস-মুরগি পালন করেন। মূলত হাঁস-মুরগি বিক্রির টাকা থেকেই পরিবারের টুকিটাকি খরচ হয়। সৈয়দ আলী প্রতিবছর একটা করে গরু (এ্যাড়েগরু) পালন করতেন এবং তা বিক্রি করে একটা মোটা টাকা পেতে বলে জানান যদিও এ বছরে টাকার অভাবে এ্যাড়ে কিনতে পারেননি!
সৈয়দ আলী জানান, ১৯৮৪ সালে তিনি গ্রাম পুলিশের চাকরি পান। সেই সময়ে তাঁর মাসিক সম্মানি ছিলো ৫০০ টাকা। তবে তিনি খুশি সেই সময়ে। কারণ ওই টাকা দিয়ে তিনি ভালোই চলতেন বলে জানান। অথচ বর্তমানে মাসে ৩০০০ টাকা পেয়েও তা দিয়ে কিছুই কিনতে পারেননি। বাজারে সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। বড় ছেলের ভালো চাকুরি হলে তিনি মানসিকভাবে সন্তুষ্ট হবেন। কেননা দীর্ঘদিন ধরে একা একা সংসারের হাল ধরে তিনি বড় ক্লান্ত হয়ে গেছেন বলে জানান। গ্রাম পুলিশের চাকরি করে দীর্ঘ ২৮টি বছর তাকে রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করে কাজ করতে হয়। ইউনিয়ন শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ভূমিকা রেখে আসছেন। অথচ তাদের কেউ খোঁজ নেয় না! তিনি বলেন, “গ্রামে কোন সমস্যা হলে আমরা যেগুলো পারি সমাধান করি। খুব জরুরি হলে মেম্বার সাহেবকে খবর দিই। গ্রামে রাতে ডিউটি করা ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদে সপ্তাহে একদিন রাত্রি ডিউটি করতে হয়। ইউনিয়ন পরিষদে ২ জন করে একদিন পর পর ডিউটি পড়ে।” তিনি আরও বলেন, “ইউনিয়ন পরিষদে কাজের মধ্যে সকাল বেলায় পরিষদ ঝাড় দিতে হয়, চেয়ার টেবিলগুলো মুছতে হয়। চেয়ারম্যান ও সচিব ভাইয়ের ঘরে খাবার পানি এনে দিতে হয়। এগুলো ছাড়াও পষিদের মিটিং বা গ্রাম আদালতের জন্য নোটিশ করলে দিতে যেতে হয়।” তিনি জানান, গ্রাম আদালতের জন্য নোটিশ করলে ৪০ টাকা করে দেওয়া হয় কিন্তু ওই টাকায় ৩০-৪০ জনের বাড়িতে চিঠি দিয়ে আসতে হয়। আবার থানাতেও চিঠিপত্র দিতে হয়। এসব কাজে খুব কষ্ট করে নিজের টাকা খরচ ক্েরই করতে হয়। তবে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তিনি যে সেবা পান সেটা স্বীকার করে বলেন, “ ইউনিয়ন পরিষদ আমাদেরকে ভিজিএফ কার্ড দিয়ে সাহায্য করেছে। এই কার্ডের চাল পাই। এটা আমাদের উপকারে আসে।”
সপ্তাহে রবি থেকে বৃহস্পতি পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদে কাজ করতে হয় বলে মো. সৈয়দ আলী জানান। তিনি বলেন, “শুক্রবার-শনিবার দিনের বেলায় বাড়ির কাজ করি। নিজের সংসারে কাজ ছাড়া ও সুযোগ পেলে অন্যের জমিতে কামলা দিয়ে আসি। এতে ২০০-২৫০ যা পাই, যা দিয়ে অন্য কাজ করা যায়।” তিনি বলেন, “ গত জুলাই থেকে সরকার আমাদের বেতন ১৯০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা করেছে। কিন্তু এই টাকা খুব একটা উপকার আমাদের হয় না। কারণ সব কিছুরই খরচ বেশি।” মাসিক সম্মানিটা যদি ৪০০০ থেকে ৫০০০ টাকা হতো তাহলে গ্রাম পুলিশে যারা চাকরি করেন তাদের মনে শান্তি থাকবে বলে তিনি জানান। তিনি আক্ষেপ করেই বললেন, “আমরা চাকরি করে যে বেতন পাই। যদি কেউ শুধু এই চাকুরির বেতনের ওপর নির্ভর করে তাহলে সে তার পক্ষে কোনভাবেই সংসার চালানো সম্ভব হবে না।”