করোনাকাল, ঘূর্ণিঝড় আমফান ও জরুরি বার্তা

ঢাকা থেকে পাভেল পার্থ:
একের পর এক বিপদ। করোনার দু:সময়েই আরেক শংকায় নির্ঘুম বাংলাদেশের উপকূল। উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় আমফান। লেখাটি যখন তৈরি করছি তখন ৭ নম্বর বিপদ সংকেত চলছে। পূর্বাভাস বলছে ১৯ মে রাত থেকে ২০ মে এর ভেতর এই ‘অতি প্রবল’ ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়তে পারে উপকূলে। বন্যা-খরার দেশে ঘূর্ণিঝড়ের এই মাতম দিনকে দিন আরো জটিল ও প্রকট হয়ে ওঠছে। সমসাময়িককালে সিডর, আইলা, মহাসেন, ফণী, বুলবুলের নির্দয় স্মৃতি মুছতে না মুছতেই আবার আমফান। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় বাংলাদেশের সক্রিয়তা ও তৎপরতা বেড়েছে। আগের গুলোর সাথে তুলনা করলে দেখা যায় বুলবুলে মানুষের প্রাণহানি কমেছে। যদিও প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ই স্থানীয় জীবনে নানামুখী দাগ রেখে গেছে। আইলায় যেমন গ্রামজনপদ ডুবেছে লবনজলে আবার বুলবুলে নিহত হয়েছে গাছ। চলতি আলাপখানি ঘূর্ণিঝড়ের প্রকৃতি এবং এর স্থানীয় প্রভাব নিয়ে নয়। করোনাকালের স্বাস্থ্যবিধি মেনে কীভাবে আমরা এই বিপদ মোকাবেলা করতে পারি এরকম কিছু প্রশ্ন হাজির করতে চায় চলতি আলাপ।


আশ্রয়কেন্দ্র ও করোনা স্বাস্থ্যবিধি
করোনাকালের ঝুঁকি নিয়েই দুর্যোগ কমিটিগুলো সভা করেছে। আশ্রয়কেন্দ্র ও পাকা দালানের স্থানীয় বিদ্যালয়গুলো প্রস্তুত করছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর অবস্থা আমাদের জানা আছে। এই কেন্দ্রগুলো নারী-শিশু-প্রবীণ-বিশেষভাবে সক্ষম মানুষের জন্য কতোটা উপযোগী এই তর্ক আবার তোলার সময় হয়তো এই করোনাকাল নয়। আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে প্রাণিসম্পদের থাকার জায়গা নেই তাই বুলবুলের সময় অনেক নারী তাদের হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগলকে নিয়ে নিজের ঝুপড়ি ঘরেই বাঁচার লড়াই করেছেন। করোনাকালের সুরক্ষাবিধি মানার মতো যথেষ্ট কেন্দ্রও আমাদের নেই। কিন্তু আমাদের তো বিপদ সামাল দিতে হবে। জীবন ও সংসার বাঁচাতে হবে। অন্যসময় এক একটি আশ্রয়কেন্দ্রে যেভাবে গাদাগাদি করে একসাথে অনেক মানুষকে থাকতে হয় এবার কী তা সম্ভব! বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রের পক্ষে কী এমন অবকাঠামোগত প্রস্তুতি আগে থেকেই নিয়ে রাখা সম্ভব? এই পরিস্থিতিতে আমাদের আশ্রয়কেন্দ্র বাড়াতে হবে। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র গুলোর সাথে যোগ করতে স্থানীয় বিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠান, হোটেল কিংবা ব্যক্তিমানুষের পাকা দালানবাড়ি। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামোটি বেশ চমৎকার। স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয়ভাবে নানা কমিটি আছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির কাজ হবে স্ব স্ব এলাকার মানুষের ঝূঁকিকে বিন্যস্ত করে তালিকা তৈরি করে ফেলা। ইউনিয়ন পরিষদের কাছে গ্রামের মানুষের ঘরবাড়ি, আয়-রোজগার ও সামাজিক অবস্থা কার কেমন সেই হিসাব আছে। অতি বিপদাপন্ন, বিপদাপন্ন, ঝূঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিমুক্ত পরিবারদের তালিকা অনুযায়ী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এই সংকটে জায়গা করে দিতে পারে দুর্যোগ কমিটি। নানাভাবে আশ্রয়স্থল বাড়িয়েই এই করোনাকালে ‘শারিরীক দূরত্ব বিধি’ বজায় রাখা সম্ভব। দুর্যোগ কমিটি, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটি ও স্থানীয় যুব প্রতিনিধিরা বরাবরই ঘূর্ণিঝড়ে একসাথে কাজ করেন। এখনও তারা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারেন। সরেজমিন দেখে প্রতিটি স্তাপনায় কত পরিবার শারিরীক দূরত্ব মেনে আশ্রয় নিতে পারেন তা এখনি ঠিক করে ফেলতে পারেন। কারণ নয়-দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আগেভাগে আশ্রয়কেন্দ্রে এসে ওঠার একটা হুড়োহুড়ি এতে সামাল দেয়া সম্ভব। এই সময় আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে আগেভাগেই। প্রতিটি কেন্দ্রে একজন স্বাস্থ্যকর্মী থাকতে পারেন। যিনি কেন্দ্রে প্রবেশের আগে সকলের সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নথিভূক্ত করবেন। কেন্দ্রের প্রবেশমুখে হাত ধোয়ার উপকরণ ও প্রয়োজনীয় ঔষধ রাখা জরুরি। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকাকালিন সময়ে কেউ করোনার উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্রুত তাকে হাসপাতালে স্থানান্তরের জন্য ব্যবস্থা রাখতে হবে। যদি এমন ঘটনা ঘটে তবে তার সংস্পর্শে আসা সকলকে বিধি মোতাবেক আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এই বিপদে সবাইকে আশ্রয় দেয়া রাষ্ট্রবিধির অংশ। কিন্তু করোনাকালে এই মানবিকবিধিই হয়তো সংক্রমণ আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। আমরা কেউ এমনতর বিপদের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আশ্রয়কেন্দ্র গুলো যেটা করতে পারে কেন্দ্রে আসা সকলের পূর্বসময়ের ভ্রমণকালিন ও সংস্পর্শের ইতিহাস জানতে পারে। প্রাথমিক তথ্য ও কোনো উপসর্গভিত্তিক লক্ষণের মাধ্যমে যদি দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে করোনা সংক্রান্ত কোনো সন্দেহ তৈরি হয় তবে এমনদের জন্য একটি পৃথক আশ্রয়কেন্দ্র আগেভাগেই প্রস্তুত করে রাখা যেতে পারে।

সতর্ক বার্তা প্রচারে ব্যস্ত একজন নারী ভলান্টিয়ার


করোনাকালে ঘূর্ণিদুর্গতদের সহযোগিতা
বরাবরই আশ্রয়কেন্দ্রে কমবেশি খাদ্য সহযোগিতা থাকে। ঘূর্ণিঝড়ের পর আরো নানামুখী সহায়তা কর্মসূচি তৈরি হয়। এবার বিষয়টি কি একইরকম থাকবে? কিংবা আগের মতোই একইভাবে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় একইরকম উদ্যোগ অব্যাহত রাখা সম্ভব? সিডর, আইলা বা বুলবুলের পর যেমন আমরা দেখেছি ত্রাণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সংস্কার, মাটিকাটা এইরকমের কাজ। যদি আমফানেও কোনো ক্ষয়ক্ষতি ঘটে তবে আমাদের সহায়তা কর্মসূচিকেও করোনাকালিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভিন্নভাবেই সাজাতে হবে। হয়তো একটা পুকুর সংস্কার করতে হতে পারে, রাস্তায় পড়ে থাকা গাছ কেটে সরাতে হতে পারে বা মানুষের জন্য খাদ্য ও প্রয়োজনীয় রসদ নিয়ে যেতে হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী এই সহায়তা জনগোষ্ঠীভিত্তিক হওয়া জরুরি, তবে স্বাস্থ্যবিধির কৌশলগুলো মানার উপায় রাখতে হবে। করোনাকালে ঘূর্ণিদুর্গতদের খাদ্য সহযোগিতার ক্ষেত্রেও বিশেষভাবেই চিন্তা করা জরুরি। করোনাকালে যেসব খাদ্যবিধি আলোচিত হচ্ছে ঘূর্ণিদুর্গতদের জন্য যারাই খাদ্য সহযোগিতা করবেন তাদের এই খাদ্যবিধি বিবেচনায় নেয়া দরকার।
পুর্বাভাস ও সতর্কবার্তা
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের আপফান মোকাবেলার খোঁজ রাখছি। ফণী কি বুলবুলের মতোই দুর্যোগ কমিটির সাথে মিলে যুবরা সতর্কবার্তা প্রচার করছে। ছবিতে তাদের মুখে মাস্ক আছে, অনেকের হাতে গ্লাভস। বুলবুলের অভিজ্ঞতায় দেখেছি পুর্বাভাস কতোটা কাজে লেগেছিল। যদিও মহাসেন বা আইলার প্রসঙ্গ ভিন্ন। এবার সতর্কবার্তা প্রচারণায় করোনাকালিন স্বাস্থ্যবিধিও একইসাথে প্রচার করা জরুরি। বিশেষভাবে ঘূর্ণিঝড়ের সময় পরিবারের সবাই বা আশ্রয়কেন্দ্রে আসার সময় সবাই যাতে যতোটা সম্ভব নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেন। এক্ষত্রে স্থানীয় দুর্যোগ কমিটি আগে থেকেই এলাকাভিত্তিক পরিবার ভাগ ভাগ করে নিকটস্থ কেন্দ্রে সবাইকে নিয়ে আসতে পারেন। গ্রাম ও আশ্রয়কেন্দ্রে এইসময় করোনার স্বাস্থ্যবিধিও যতোটা সম্ভব জানানো জরুরি।


এবারো আশা সুন্দরবন
সিডর থেকে বুলবুল। বারবার নিজের জীবন দিয়ে সুন্দরবন সুরক্ষা করে চলেছে উপকূল। সুন্দরবন অঞ্চলে কথা বলেছি, এখনো বনজীবী মৌয়ালি, বাওয়ালি, জেলেদের শতভাগ আস্থার এই বাদাবনের ওপর। বুলবুলের সময়ের মতোই এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে একটা দোটানা আছে বনজীবী পরিবারে। এর সাথে যোগ হয়েছে করোনাভীতি। আমরা সুন্দরবনের সাথে উন্নয়ন-বাহাদুরি করি না কেন এই রক্তলাগা বন আবারো নিজের জীবন দিয়ে সামাল দেয়ার চেষ্টা করবে আমফান। কিন্তু বনজীবীসহ উপকূলবাসীদের করোনাভীতি দূর করে তাদের নিরাপদ সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে আইলার মতো নির্দয় প্রাণহানি ঘটতে পারে।
উপকূল বাঁধে ফাটল বন্ধ হবে কবে?
রাষ্ট্র নানা বিধি ও বাজেট করেছে উপকূল সুরক্ষায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ একেবারেই এসব মান্য করেনি। উপকূল থেকে হাওর কোথাও বাঁধ সুরক্ষিত নয়। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বাঁধে ভয়াবহ ফাটল। যেকোনো সময় তলিয়ে যেতে পারে। তো এই ফাটল তো আর একদিনে মেরামত করা যাবে না। কিন্তু করোনাকালে আমাদের প্রতিজ্ঞা করা দরকার আমরা আমাদের উপকূল সুরক্ষিত করবো। হয়তো ঘূর্ণিঝড়সহ দুর্যোগ মোকাবেলায় করোনার মতো কোনো মহামারী সামাল দেয়ার নতুন বিধি যুক্ত হবে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও বাজেটে। নতুন কিছু যুক্ত হবে জাতীয় দুর্যোগ পরিকল্পনা নীতিতে।
উপকূলের তরুণ ও সেন্দাই লক্ষ্যপূরণ
২০১৫ থেকে ২০৩০ পনের বছরের জন্য দুর্যোগ মোকাবিলায় ‘সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক’ নামে বৈশ্বিকভাবে দুর্যোগ সামালের এক কাঠামো তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশও এই কাঠামোর আলোকে জাতীয় দুর্যোগ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। নিত্যনতুন নানা কৌশল ও বিধি যুক্ত হচ্ছে দুর্যোগ মোকাবেলায়। কিন্তু করোনাকালিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে এর আগে দেশে ঘূর্ণিঝড়ের মতো কোনো আপদ-বিপদ সামাল দিতে হয়নি। মানুষ প্রতিটি আপদ-বিপদ থেকেই এক একটি নতুন বাঁচার পথ খুঁজে নেয়, যা কৌশল হয়ে সমাজে চর্চা হতে থাকে। হয়তো করোনাকালিন আমফানও আমাদের এমন অনেক লোকায়ত জনকৌশল সামনে আনবে। কিন্তু লেখাটি শেষ করতে চাই ত্রিশ বছর বয়সী উপকূলের যুব-তরুণদের দিকে তাকিয়ে। সিডর থেকে বুলবুল এই বয়সেই যাদের সামাল দিতে হয়েছে পাঁচটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়। প্রতিটি দুর্যোগের পরই বদলে যেতে বাধ্য হয়েছে যাদের জীবন ও ইচ্ছেগুলি। আইলার পর এই গ্রামীণ তরুণদের একটা বড় অংশই লবনপানিতে কৃষিকাজ হারিয়ে ইটেরভাটায় শ্রম বেচতে বাধ্য হয়েছে। করোনাকালে আবারো কাজ হারিয়ে ফিরেছে উপকূলের গ্রামে। করোনার বিপদের ভেতর আবার আমফান, ছোট্ট এক তরুণ জীবনে কত আর সয়! কাজহারা এই তরুণেরা জানে না সামনে কী আছে, করোনার পর দুনিয়া কেমন হবে। জানে না আমফানে কতোটা আবার বদলে যাবে জীবন। দুর্যোগের প্রস্তুতি তখনি জোরালো হয় যখন মানুষের সামাজিক বঞ্চনা, বৈষম্য আর আহাজারি দূর হতে থাকে, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সক্ষমতা বাড়তে থাকে। উপকূলের একটা বড় অংশ এই তরুণ যুব সমাজ। ঘূর্ণিঝড় কী করোনা মোকাবেলায় এরাই এখনো নির্ঘুম। পরিবার ও সমাজের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বিপদ ও দুর্যোগ মোকাবেলার দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি হিসেবে এই তরুণদের জন্য বিশেষভাবেই আমাদের মনোযোগী হতে হবে। সক্রিয় হতে হবে। এটিই করোনাকালিন ঘূর্ণিঝড় আমফানের একটি জরুরিবার্তা।

happy wheels 2

Comments