নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলি
সিলভানুস লামিন
এক
২০২০ সাল। কিছুদিন আগেই গত হয়েছে। ২০২০ সালটা আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কি নিদারুণ কষ্ট, আতংক ও ক্ষতিই না নিয়ে আসলো। কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপী সবকিছুই বলতে গেলে স্থবির ছিল। মানুষের কর্মচাঞ্চল্য ও কর্মব্যস্ততা থামিয়ে ২০২০ সালটি মানুষকে কয়েকবছর পিছিয়ে দিয়েছে। অর্থনীতি থেকে শুরু শিক্ষাব্যবস্থাকে পর্যন্ত তছনছ করে দিয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি ধীরে ধীরে জেগে ওঠতে শুরু করলেও শিক্ষাব্যবস্থা এখনও কোভিড-১৯ এর প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন ও বেকার হয়েছে এবং কোটি কোটি মানুষ নানান শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগেছে। কাজ হারিয়ে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করেছে। স্বজন হারানো অনেক মানুষ এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি। এই স্থবিরতার মাঝেও কি ২০২০ সাল আমাদের জীবনে ইতিবাচক কিছু নিয়ে আসেনি? হয়তো ভালো কিছু নিয়ে আসেনি কিংবা হয়তো কারও কারও জীবনে এর মধ্যেও ইতিবাচক কিছু ঘটেছে। তবে সামগ্রিকভাবে বলতে পারি, নানান নেতিবাচকতার মধ্যেও ২০২০ সালের একটি ইতিবাচক দিক হলো মানুষ আশা হারাননি, স্বপ্ন বাস্তবায়ন থেকে তারা পিছপা হননি। মহামারীর সাথে লড়াই করেছেন উদ্যমের সাথে!
দুই
২০২১ সাল। একটি নতুন বছর। নতুন বছরে নতুন আশা, স্বপ্ন ও আকাঙ্খা নিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। বিগত বছরের সব ধরনের ক্লান্তি, পঙ্কিলতা ও নেতিবাচকতা ভুলে আমরা এ নতুন বছরে নতুন করে আবারও আমাদের পথচলা শুরু করেছি। ২০২১ সাল মাত্র ১১ দিন পেরিয়েছে। আজ ২০২১ সালের ১২তম দিন। একটি নতুন দিন। আমাদের জীবনে প্রতিদিনই একটি নতুন দিন। ১১ জানুয়ারির রাতে ঘুমে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা সবাই আশাবাদী ছিলাম যে, আগামীকাল আমরা আবার জেগে উঠবো। এই ‘আশা’ নিয়েই কিন্তু আমরা প্রতিদিন আমাদের পথচলা শুরু করি। আশা আছেই বলেই আমরা আজ অনেককিছু করার আত্মবিশ্বাস ও প্রেরণা পাই। আমাােদর এই ‘আশা’কে কেন্দ্র করেই আমাদের পরিবারের সদস্যদের জীবন আবর্তিত হয়। এই ‘আশা’ই কিন্তু আমাদের জীবনকে প্রতিদিন নতুন ও বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সহযোগিতা করে। আজ ১২ জানুয়ারি নতুন একটি সূর্য উদয় হয়েছে। আমরাও ঘুম থেকে জেগে নতুন আশা নিয়ে আমরা কর্মব্যবস্ততা শুরু করি, নতুন অভিজ্ঞতা ও নতুন কিছু অর্জনের জন্য ছুটে যাই নিজ নিজ কর্মস্থলে। প্রকৃতপক্ষে নতুন একটি দিন নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়ে হাজির হয় আমাদের প্রত্যেকের কাছে। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই ‘প্রতিটি দিনই’ সমান নয়; কোনদিন আমরা অনেককিছু অর্জন করি, কোনদিন আমরা কম অর্জন করি। কোনদিন আমরা অনেক বেশি কাজ করি কোনদিন আমরা কম কাজ করি, কোনদিন আমরা কষ্ট পাই, কোনদিন আমরা আনন্দে আপ্লুত হই। তাই জীবনের প্রতিটি দিনই বৈচিত্র্যময় এবং বিচিত্র ধরনের অভিজ্ঞতা হাজির করে আমাদের কাছে। তাই আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হয়, নিজেদের তৈরি করতে হয় এসব বিচিত্র ও সম্ভাবনাময় কিছু আমাদের জীবনের প্রাপ্তির খাতায় যুক্ত করতে। মনে রাখি, একেকটি নতুন দিনের যোগফলই হচ্ছে একটি বছর। প্রতিটি নতুন দিনেই নতুন কিছু যুক্ত হয় আমাদের প্রাপ্তিখাতায়! প্রতিটি নতুন দিনের ‘প্রাপ্তির যোগফল’ বছরশেষে আমাদেরকে আনন্দে আপ্লুত করবে!
তিন
কোন একজন ব্যক্তি বলেছেন, ‘মানুষের সবচে’ বড় ক্ষমতাই হচ্ছে স্বপ্ন দেখা।’ আমার কাছেও মনে হয় এটি আমার সবচে’ বড় ক্ষমতা। আমার স্বপ্ন আছে বলেই প্রতিটি দিন নিজেকে তৈরি করি, প্রতিদিন নতুন কিছু জানার ও শেখার চেষ্টা করি। যাতে করে আমার লালিত স্বপ্নকে তাড়া করতে পারি। আমরা সবাই কমবেশি স্বপ্ন দেখি। প্রতিদিনই আমরা নানান রকমের স্বপ্ন দেখি! তবে আমাদের কিছু স্বপ্ন আছে, যা আমাদেরকে ঘুমাতে দেয় না। কোন এক মনীষী বলেছেন, ‘তুমি সেই স্বপ্নকে তাড়া করো যে স্বপ্ন তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।’। যে স্বপ্ন আমাদের ঘুমাতে দেয় না সেটি অবশ্যই সেই ধরনের স্বপ্ন, যে স্বপ্ন আমাকে ও আমার পরিবারকে কিংবা আমার সমাজ ও দেশকে লাভবান করবে, সমৃদ্ধ করবে, গৌরবান্বিত করবে। স্বাভাবিকভাবে এই বড় স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন সাধনা, আত্মবিশ্বাস, উদ্যম, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং কর্মনিষ্ঠতা ও সময়নিষ্ঠ হওয়া। পৃথিবীতে যারা তাদের লালিত স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে পেরেছেন তারা সবাই কর্মঠ ছিলেন, আত্মবিশ্বাসী, উদ্যম ছিলেন, ছিলেন সময়নিষ্ঠও। তাই আসুন আমাদের প্রতিটি কাজেই আমরা আত্মবিশ্বাসী, উদ্যমী ও নিষ্ঠাবান থাকি। আমাদের কাছে অর্পিত দায়িত্বগুলো প্রতিদিনই সুচারুভাবে সম্পাদনের মাধ্যমেই আমরা আমাদের সেই স্বপ্নের এক একটি সিঁড়ি বেয়ে উঠি এবং এক পর্যায়ে কাঙ্খিত সেই স্বপ্নের কাছে পৌছে যাবো। নতুন বছরে আমরা নিজেদের কাছেই শপথ করি, আমরা প্রতিটি দিনই আমাদের লালিত স্বপ্নকে তাড়া করবো নিষ্ঠার সাথে, আত্মবিশ্বাসের সাথে এবং আন্তরিকতার সাথে। লালিত স্বপ্নকে তাড়া করার প্রতিদিনের এই প্রচেষ্টাই বছর শেষে গন্ত্যবের কাছে আরও এক ধাপ আমাদেরকে নিয়ে যাবে।
চার
আমরা যারা বারসিক-এ কাজ করি আমাদের সবারই কিছু স্বপ্ন ও আশা ছিলো, এখনও আছে। ২০২০ সালে হয়তো সেই স্বপ্নকে তাড়া করতে বাধাগ্রস্ত হয়েছি এবং আমাদের অনেকের আশা পূরণ হয়নি নানান কারণে বিশেষ করে কোভিড-১৯ এর কারণে। তবে এত সীমাবদ্ধতা ও বাধা থাকার পরও আমরা কিন্তু আমাদের কাজগুলো বিভিন্নভাবে সম্পাদন করেছি। ২০২০ সালে আমার কাছে অনেক লেখাই এসেছে। সবকিছু ফিল্টার করার পর বারসিকনিউজ-এ ৬৩৯টি লেখা আপলোড করা হয়েছে। এসব লেখাগুলো বারসিক’র চারটি কর্মএলাকা থেকে এসেছে এবং বারসিককর্মীরাই এসব লেখা লিখেছেন। পরিবেশ, প্রকৃতি, নানান তৃণমূল উদ্যোগগুলো নিয়ে লেখাগুলো সাজানো হয়েছে। এছাড়া বারসিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের অনেকগুলো সংবাদও আপলোড করা হয়েছে এই কঠিন সময়ের মধ্যে। বারসিক’র কাজের মূলনীতিই হলো-মানুষের কাছে শেখা। আমরা মানুষের কাছ থেকে নিরন্তরভাবে শিখেছি, জানার চেষ্টা করেছি এবং তাদের জীবনদর্শন উপলদ্ধি করার চেষ্টা করেছি। মানুষের কাছে শেখার এই মানসিকতা ও প্রবণতাই আমাদেরকে এতগুলো লেখা তৈরি করতে সহায়তা করেছে। আমরা সবসময়ই চেষ্টা করি কাজের ভেতর দিয়েই মানুষকে তথ্য দিতে, তাদের খুব কাছে থেকে প্রভাবিত করতেও চেষ্টা করি। এছাড়া যে বিষয়গুলো তারা জানেননা সে বিষয়ে তাদেরকে শেখানোর আন্তরিকতা রয়েছে আমাদের। অন্যদিকে আমাদের উদ্যোগগুলোতে তাদের আশা, আকাঙ্খা ও প্রয়োজন প্রতিফলিত হয় এবং এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে তারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারেন বলে আমাদের কাজে তারা বিনোদনও খুঁজে পান। তাই আমাদের কাজের যে স্পৃহা, উদ্দীপনা ও মনোবল রয়েছে নতুন বছরে সেগুলোকে আরও শক্তিশালী করি, আর গতিশীল করি।
পাঁচ
করোনা পরিস্থিতির মাঝেও আমরা বারসিক-এর সদস্যরা মানুষের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্ষেত্রবিশেষে অনুষ্ঠানও করেছি। আবার অনলাইন প্লাটফরমকে কাজে লাগিয়ে প্রতিনিয়তই আমাদের কাজগুলো সম্পর্কে তাদের অবগত ও হালানাগাদ করতে পেরেছি। মানুষের সাথে কানেকটেড বা সংযুক্ত থাকার কারণে আমরা গত বছর অনেকগুলো গল্প, ফিচার রচনা করেছি। আমরা যা কিছু করেছি বা করছি সেটা পরিবার তথা সমাজ উন্নয়নের জন্যই করছি। তাই আশা করছি, নতুন এ বছরে আমরা দ্বিগুণ আশা ও উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করবো এবং বারসিকনিউজ এর জন্য গল্প তৈরি করবো আমাদের কাজের ফলাফল থেকে। বারসিক’র অর্জনগুলো আমরা মূলত বারসিকনিউজ ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বা মানুষের কাছে পৌছানোর চেষ্টা করি, রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করি। তাই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য আমরা যে উদ্যোগ বা কাজগুলো শুরু করেছি নতুন বছরে আরও সুনিপুণ ও সাবলীলভাবে করার প্রত্যয় ব্যক্ত করি। কারও কোন গল্প আপলোড বা ছাপা না হলেও যাতে আমরা মনোবল না হারাই। লিখতে থাকি, বলতে থাকি অনবরত। শেষ করার আগে একটি কথা বলি: আমরা সমাজের মানুষ। সমাজের উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং গতিশীলতা নির্ভর করছে আমাদের ওপর। সমাজের উন্নয়নের জন্য তাই আসুন আমরা ‘লড়াই’ করি। যদি লড়াই করতে না পারি তাহলে সংশ্লিষ্টদের বরাবরে ‘কথা’ বলি, যদি কথা বলতে না পারি তাহলে কলম ধরে লিখি। যদি লিখতেও না পারি তাহলে যারা এ লড়াই করে তাদের ‘উৎসাহিত’ করি। আরযদি উৎসাহিত করতে নাও পারি তাহলে দয়া করে যারা লড়াই করে তাদের মনোবল না কমাই। কারণ তারা আমাদের ভাগটা নিয়েই লড়াই করছেন। নতুন বছরে তাই আসুন আমরা আরও বেশি আশাবাদী হই, আরও বেশি করে স্বপ্নবাজ হই।