রাহেলা বেগম একজন পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চাকারী
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে জেগেছেন রাহেলা বেগম। প্রতিদিন বাড়ির সবার আগে ঘুম থেকে জেগে উঠেন। বাড়ি ঘর পরিষ্কার করে, হাড়ি পাতিল ধুয়ে রান্নার কাজ শুরু করেন। গোয়ার ঘর পরিষ্কার করে গৃহপালিত প্রাণীগুলোর খাবার দেওয়া, বাড়ির সবার খাবার পরিবেশন ইত্যাদি কাজ যা আমাদের সমাজে এখনো নারীদের কাজ হিসেবে স্বীকৃত সেই কাজগুলো শেষ করে শুরু করেন অন্য কাজ। আজ বাজার বার বাজারের সবজি পাঠাতে হলে রান্না খাওয়া শেষ করে বাজারের বিক্রয় জন্য সবজি তুলতে হবে। নেত্রকোনা জেলা আমতলা ইউনিয়নের রাহেলা বেগমের বয়স এখন প্রায় ৬৫ বছর। এক সংগ্রামী বিধবা নারী রাহেলা বেগম। পনের ষোল বছর বয়সে বিয়ে পর থেকে যে কাজগুলো শুরু করেছেন; এখনো সে কাজগুলো করে যাচ্ছেন। গ্রামীণ সেই সংগ্রামী নারীর দীর্ঘ জীবনের পথ চলার কিছু উদ্যোগ সম্পর্কে জেনে নিই।
সীমিত সম্পদের ব্যবহারকারী
রাহেলা বেগমের বাড়ির জমি ৩০ শতাংশ। এই জমিকে পুঁজি করেই পরিবারের পুষ্ঠির চাহিদা পূরণ, তিন সন্তানদের পড়ার খরচ চালানো, চিকিৎসাসহ যাবতীয় কাজ পরিচালনার করে থাকেন। বাড়ির চারপাশের এক ইঞ্চি জমিও সারাবছর খালি পরে থাকেনা তাঁর। কঠোর পরিশ্রমী রাহেলা বেগম দিনের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেন বাড়ির উঠানের সবজি বাগান ও ফলজ গাছকে পরিচর্যা করে।
বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ
রাহেলা বাড়ির উঠানে মাচা তৈরি করে সবজি চাষ করেন। বর্ষায় পুঁইশাক চিঙ্গা, চাল কুমড়া কাকরুল চাষ করেন। মাচার চারপাশে চাষ করেন মৌসুম অনুযায়ী মসলা হলুদ, মরিচ, ধনিয়া ইত্যাদি। চলতি মৌসুমে বর্ষার শুরুতে ডাটা, পাট শাক চাষ করে পাট ডাটা শেষ হতে প্ুঁইশাক, জিঙ্গে লাগিয়েছেন। শীত মৌসুমে আগাম সিম, লাউ চাষের প্রস্তুতি নেন তিনি। তাঁর বাগানে রয়েছে তিন ধরনে কচু। পরিবারের চাহিদা পূরণ করে প্রতিবেশিদের মাঝে বিতরণও করেন তিনি। প্রতিবছর প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকার সবজি বিক্রয় করেন ।
স্থানীয় জাতের ফলজ গাছ
সবজি চাষ করে থেমে থাকেনি রাহেলা বেগম। বাড়ির চারপাশে লাগিয়েছেন বৈচিত্র্যময় স্থানীয় জাতের ফলজ গাছ। আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, জলপাই, নারকেল, আমড়া, চালতা, লিচু, বড়ই পেঁপে পাশাপাশি নানা জাতের কলা আর সুপারি গাছগুলো বাড়িটিকে তৈরি করেছেন সবুজ সিগ্ধ শান্তির নীড়ে। প্রতিটি গাছে ফলন শুরু হয়েছে। যার মাধ্যমে পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে বাজারে বিক্রয় করেন।
গবাদিপশু পালনকারী
রাহেলা বেগম একজন আর্দশ গবাদি পশু পালনকারী। সারাবছর বাড়িতে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, কবুতর পালন করেন। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে পশু পালন করলেও রাহেলা বেগমের পশু পালন গ্রামের অনেক দরিদ্র নারীকে গৃহপালী পশু পালনে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। প্রতি বছর ৪ থেকে ৫টি ছাগল বিক্রয় করেন। চলতি বছরে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকার ছাগল বিক্রয় করেছেন। গরু বিক্রয় করেছেন লক্ষ টাকা।
বীজ সংরক্ষণকারী
তিনি একজন স্থানীয় জাতের সবজি বীজ সংগ্রহকারী। বাড়িতে যে ধরনে সবজি চাষ করেন সব ধরনে বীজ সংরক্ষণ করেন, যা নিজের রোপণের জন্য রেখে প্রতিবেশীদের মাঝে বিতরণ করেন। সবজি বা ফলের বীজ সংগ্রহ করেন নিজস্ব লোকায়ত চর্চার মাধ্যমে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ফল ধরার শুরুতে বীজ রাখতে নেই। মাঝা মাঝা সময় বীজ রাখতে হয়। এতে করে বীজটা পুষ্ট থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বীজ নিজের ঘরে রাখা সবার উচিত। বাজারের বীজ সব সময় ভালো থাকে না। নিজের হাতে বীজ থাকলে সাহস থাকে। সময় মতো লাগানো যায়।
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনকারী
রাহেলা বেগম সারাবছর বাড়িতে যে গৃহপালিত প্রাণীগুলো পালন করেন তা থেকে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি বিষ্ঠা, গোবর নির্দিষ্ট স্থানে সংগ্রহ করে সবজি ক্ষেতে প্রয়োগ করেন। এতে করে বাজারের সার ব্যবহার করা লাগেনা। সেই সাথে সবজি পুষ্টি গুনাগুণ ও স্বাদ ঠিক থাকে। এই কারণে বাজারের তাঁর সবজির চাহিদা বেশি থাকে। সার দেওয়া, হাইব্রড সবজি চেয়ে বাজারে স্থানীয় সবজি ও ফলের চাহিদা বেশি। গ্রামের অনেক কৃষাণী বাড়ি থেকে সবজি নিয়ে যায় ।
একজন আদর্শ মা
রাহেলা বেগমের স্বামী মারা গেছেন চার বছর আগে। সংসারের হাল তাই রাহেলা বেগমকে নিতে হয়েছে। এছাড়া তাঁর স্বামী বেঁচে থাকার সময়েও তিনিই সংসারের হাল ধরেছেন কারণ তার স্বামী অসুস্থ ছিলেন। তিনি তাঁর তিন সন্তানের পড়ালেখা চালিয়ে গেছেন। তাঁর এক ছেলে ময়মনসিংহ ডিগ্রী কলেজে, এক ছেলে ৮ম শ্রেণীতে এবং এক ছেলে ৭ম শ্রেণীতে পড়ছে। পড়াশোনা পাশাপাশি ছেলেদের দিয়েছেন সুশিক্ষা। তাঁর প্রতিটি ছেলে পড়ার ফাঁকে এখন মায়ের সাথে কৃষির কাজ করে। পরিচর্যা করে বাড়ির ফলজ গাছগুলো। গৃহপালিত প্রতিটি পশুর কিভাবে যতœ করতে হয় সে বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তারা মায়ের কাছ থেকে। পড়ার ফাঁকে ছুটিতে বাড়িতে আসলেও ছুটে যায় কাজের সন্ধ্যানে। কখনো দরিদ্র কৃষকের ধান কাটতে কখনো বা সামান্য টাকায় ধানকেটে নিয়ে আসে কিছু টাকা! এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘শুধু বই পড়ালে হইবো না; সন্তানকে মানুষ বানাইতে হইবো। যে সত্যিকারের মানুষ সে অন্য মানুষকে সম্মান দিতে জানে।’
এবং শতবাড়ির রাহেলা বেগম
পরিবেশ রক্ষা ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনকারী রাহেলা বেগমের সাথে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বারসিক। কখনো বীজ সহায়তা, কখনো বা গাছ দিয়ে সহায়তার মাধ্যমে রাহেলার বেগমের স্বপ্নের বাড়ি তৈরিতে সহায়তা করে আসছে। এক চিলতে জমিকে কাজে লাগিয়ে নিজের পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ, প্রতিবেশীদের সবজি চাষে উদ্বুদ্ধকরণ, সেই সাথে নিরাপদ খাদ্য বাজারে বিক্রয় করে গ্রাম ছাড়িয়ে শহরের অনেক পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করছেন এই রাহেলা বেগম। রাহেলা বেগমের এ বৈচিত্র্যময় জীবনব্যবস্থাকে বিবেচনা করে বাড়িটিকে তাঁর বাড়িটিকে একটি ‘শতবাড়ি’ হিসেবেই নির্বাচন করে বারসিক।
রাহেলা বেগমের মতো হাজারো দরিদ্র নারী দিনের পর দিন পরিবারের ব্যয়সাশ্রয়ী শত কাজ করেও পরিবারের সকল দায়িত্ব হাতে তুলে নিয় নিজের সামান্য সম্পদকে কেন্দ্র করে। নিজের অজান্তেই ভূমিকা রাখেন আমাদের দেশের নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে এবং পরিবেশ রক্ষা করতে। রাহেলা বেগমের মতো আমাদের দেশের সব নারীর কাজকে সামাজিক স্বীকৃতি বা মূল্যায়ন করতে হবে।