আমার জীবন আমরা সংগ্রাম

রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
রাজশাহীর তানোর উপজেলার ছেলামপুর গ্রামের যোগেশ কর্মকার (৭৫)। বয়সের ভারে ও পুষ্টিহীনতায় নতজানু। দারিদ্রতার জন্য এখনও তাঁকে নিজের আদি পেশা কামারের কাজ করতে হয়। আবার কখনও কখন তানোর উপজেলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে করেন শীলপাটা ধার করানোর কাজও করেন। বয়স হয়েছে বলে এখন আর তেমন কাজ করতে পারেন না। দুইজন ছেলে থাকলেও তারা স্ত্রী-ছেলে মেয়ে নিয়ে আলাদা থাকেন। বয়সের কারণে প্রায় সময়ই নানান অসুখ-বিসুখ লেগে থাকে তাঁর। নিয়মিত ঔষধ খেতেই হয় তাকে। ঔষধের টাকা যোগারের জন্যও করতে হয় তাকে। গতবছর তাঁর স্ত্রী মারা যাওয়ার কারণে তিনি আরও একা হয়ে পড়েছেন। সারাদিন পরিশ্রম করে যা জোটে বাজার করে সন্ধ্যায় নিজেই রান্না করেন। আবার পরের দিন কাজের উদ্দেশ্য নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন।
সারাজীবন কষ্ট করে ছেলে মেয়ে মানুষ করে বিয়ে দিয়েছেন নিজের সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই। এখন একমাত্র সম্বল হচ্ছে তাঁর একটি ঝুপড়ি ঘর। যেখানে আছে ঘুমানোর জন্য একটি চকি, একটি কাঁথা আর বালিশ। জীবন চালাতে তাই এই শেষ বয়সে ছুটে চলতে হয় গ্রাম থেকে গ্রামে।


যোগেশ কর্মকারের জন্ম পাশের গোদাগাড়ি উপজেলার কাকনহাট এলাকায়। ভালোভাবে বাঁচার আশায় নিজের ৩০ বছর বয়সে পরিবার নিয়ে তানোর উপজেলার ছেলামপুর এলাকায় এসে সরকারি খাস জমিতে বসবাস শুরু করেন। সেখানে ১৮ পরিবারে বসবাস। দারিদ্রতার কারণেই যোগেশ কর্মকারের কষ্টের খোজ নেওয়ার মতো মানুষ নেই। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি কাউকে দোষ দিই না। কারণ দোষ আমার ভাগ্যর! শুধু চাই, মরার আগে পর্যন্ত যেন কাজ করে যাওয়ার ক্ষমতা থাকে আমার।’


একটি শীল-পাটা ধার করে ৩০-৪০ টাকা আয় হয় তাঁর। সারাদিন মিলিয়ে ৫-৬টি কাজ করতে পারেন। বয়স হয়েছে বলে আগের মতো আর কাজ করতে না পারলেও ধান কাটার সিজনে কাঁচিতে ধার কেটে ভালো টাকা আয় করেন। তখন দিনে ৩০০-৪০০ টাকা আয় হতো। একটি কাঁচি ধার করে ৫০-৬০ টাকা আয় হয় তখন। তখন গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হয় না। তানোরের গোল্লাপাড়া হাটের এক জায়গায় বসেই কাজ করা যায়। তাঁর শ^াস-কষ্ট থাকায় নিয়মিত ঔষধ খেতে হয়। তাই দিনের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যায় ঔষধ কিনতেই। তিনি বলেন, ‘যখন কাজ থাকে না বা কাজ করতে পারিনা তখন ঔষধ না খেয়েই থাকি। কখনও কখনও কারো কাছে ধার দেনা করে ঔষধ কিনে নিয়ে আসি।’


তিনি জানেন বয়ষ্কদের ভাতা দেওয়া হয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে। তিনি সেখানে যোগাযোগও করেছেন। কারণ ভাতা পেলে নিয়মিত ঔষধ খাওয়ার টাকার ব্যবস্থা হবে তাঁর। কিন্তু সেখানে গিয়েই তিনি জানতে পারেন তাঁর ভোটার আইডি/জাতীয় পরিচয়পত্রে এখনও ভাতা পাওয়ার মতো বয়স হয়নি তাঁর! বয়ষ্ক ভাতা পেতে ৬৫ বছর বয়স হতে হয়। কিন্তু একটু ভুলের কারণে তাঁর বয়স এখনও ৫৭ বছর! তালন্দ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জানানো হয় এটা সংশোধন করতে হবে। এটা করতে একটু সময় লাগবে। তিনি কয়েকদিন ঘুরে ঘুরে এখন আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এ ভুল আমার না হলেও এখন দায় আমার। আসলে আমার ভাগ্যরই দোষ!


ভাগ্যর উপর সব ছেড়ে দিলেও কাজ তিনি ছাড়তে পারছেন না। কারণ জীবন তো আর থেমে থাকবে না। জীবনের প্রয়োজনেই তিনি নিয়মিত ছুটে চলেন গ্রাম থেকে গ্রামে। তাঁকে এভাবেই সংগ্রাম করে জীবন চালাতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

happy wheels 2

Comments