আমার দোকানের সৌন্দর্য্য বেড়েছে, বেড়েছে বেচাকেনাও
মানিকগঞ্জ থেকে নজরুল ইসলাম
“চা বিক্রি করে আগের তুলনায় ৭০-৭৫% লাভ বেশি হয়। এখন সংসারে এত চাপ পড়ে না। প্রচলিত চুলার চেয়ে এই চুলায় চা বিক্রি করে আমার দোকানের সৌন্দর্য্য বেড়েছে, বেড়েছে বেচাকেনাও। আমি আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত দিক থেকে আগের তুলনায় অনেক ভালো আছি।” কথাগুলো বলেছেন মানিকগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বেতিলা-মিতরা ইউনিয়নের কালীবাড়ি গ্রামের চা বিক্রেতা আলমগীর হোসেন।
আলমগীর হোসেন কেরোসিন চালিত টিনের চুলা, স্টোভ, জার ও মাটি দিয়ে তৈরি এক ধরনের চুলা ব্যবহার করেন। ওই চুলায় তিনি জ্বালানি হিসেবে লাকড়ি ব্যবহার করেন। তবে নিম্ন মানের এই চুলায় তার প্রচুর জ্বালানি খরচ হতো। এতে চা বিক্রি করে তিনি খুব বেশি লাভ পান না। চা বিক্রির একটি অন্যতম দিক হলো বেচাকেনা হোক বা না হোক সারাদিন চুলা জ্বালিয়ে রাখতে হয়। ফলে অনেক জ্বালানি ব্যয় হয। সকালে আর রাতে বেচা-বিক্রি ভালো হয় তবে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খুব কম বেচা-বিক্রি হয় তবুও চুলা জ্বালিয়ে রাখতে হয় বলে তিনি জানান। এতে করে বিক্রিত চায়ের টাকার সিংহভাগ ব্যয় হয় জ্বালানি ক্রয় করতে। আলমগীর হোসেন জানান, তিনি প্রতিদিন ১৫০-১৭০ কাপ চা বিক্রি করেন। দিন শেষে হিসাব করে দেখেন সব মিলিয়ে (বিস্কুট, সিগারেট, বিড়ি) দোকানে ১৭০০-১৮০০ টাকা বেচা-কিনি হলেও সারাদিনে ৫০০ টাকাও লাভ থাকে না তার। তার মতে, প্রতিদিন অন্তত ৫০০ টাকা লাভ না হলে তো সংসার চালানো মুশকিল। তিনি বলেন, “হিসাব কষে দেখলাম আমার জ্বালানি ব্যয় প্রচুর। ৬৭-৬৮ টাকা লিটার কেরোসিন প্রতিদিন ৩-৩.৫০ লিটার খরচ হয়। এছাড়া লাকড়ি দিয়ে চুলা জ্বালালেও প্রতিদিন এক লিটার কেরোসিন ব্যয় হয়। এর সাথে চা পাতি, চিনি, দুধ তো আছেই। এভাবে খরচ করে নিজের পরিশ্রম ধরলে তো কিছুই থাকে না আমার।”
এ হিসাব থেকে তিনি দেখতে পান প্রতিদিন তিনি যদি জ্বালানি খরচটা কমাতে পারতেন তাহলে এই পেশায় লাভবান হতে পারেন। তাই তিনি উপায় সন্ধান করে কীভাবে এই খরচটা কমানো যায়! এভাবে একদিন তিনি মানিকগঞ্জ বড় সরুন্ডি এলাকায় উন্নত চুলা তৈরির কৌশল দেখেন। সেখানে উন্নত চুলার কারিগরদের চুলা তৈরির কলাকৌশল দেখে নিজে শিখে নেন কীভাবে এই চালা তৈরি করা যায়। এছাড়া তিনি তাদের কাছে উন্নত চুলার উপকারিতা সম্পর্কেও জানতে পারেন। উন্নত চুলার তৈরির কলাকৌশল ও উপকারির দিকগুলোর জানার পর তিনি তার গ্রামের ফিরে নিজেই এই চুলা তৈরির উদ্যোগ নেন। একজন রাজমিস্ত্রির সহযোগিতা নিয়ে তিনি ইট, বালি, সিমেন্ট ও ৪টি রডের পাত তৈরি উন্নত চুলা। এই প্রসঙ্গে আলমগীর হোসেন বলেন, “এখন আমি এই চুলার মাধ্যমে প্রতিদিন চা বিক্রি করি এবং নিজের পরিশ্রম ছাড়া কোন জ্বালানি ব্যয় হয় না। এই চুলার জ্বালানির জন্য আমাকে বেশি কষ্ট করতে হয় না। কারণ বাড়িতে গরু আছে, গরুর গোবর দিয়ে ঘসি তৈরি করি। এছাড়া বাড়ির ধান ভাঙ্গানো কৃড়া, ডালপালাসহ অন্যান্য লাকড়ি আমার বাড়িতে সহজেই পাওয়া যায়।”
তিনি জানান, এই চুলার ধোঁয়া কম হয় বলে চোখ-মুখ জ্বালা করে না, ধোঁয়া বেশি হয় না। এই চুলায় আগুন ধরালে আগুন অনেকক্ষণ স্থায়ী থাকে, লাকড়ি না থাকলেও প্রায় একঘণ্টা চুলা গরম থাকে। ধোঁয়া কম হওয়ায় থাকায় তার ও ক্রেতাদের কোন সমস্যা হয় না। তিনি আরও জানান, পানি পর্যাপ্ত গরম থাকে বিধায় সারক্ষণ চা পাওযা যায়। ফলে বেচাকেনা আগের চেয়ে একটু বেশি। বর্তমানে তিনি প্রতিদিন প্রায় ২০০ কাপ চা বিক্রি করেন। প্রতিকাপে কমপক্ষে এক টাকা লাভ হয় তার। তিনি বলেন, “চা বিক্রি করে আগের তুলনায় ৭০-৭৫% লাভ বেশি হয়। এখন সংসারে এত চাপ পড়ে না। প্রচলিত চুলার চেয়ে এই চুলায় চা বিক্রি করে আমার দোকানের সৌন্দর্য্য বেড়েছে, বেড়েছে বেচাকেনাও। আমি আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত দিক থেকে আগের তুলনায় অনেক ভালো আছি।”
আলমগীর হোসেন দুই সন্তানের জনক। কৃষি কাজে পরিবারের অভাব অনটনে তিনি ঘরে না থেকে নিজেই বিনা পুঁজিতে বা স্বল্প পুঁজিতে এই ছোট ব্যবসা শুরু করেন। চা বিক্রির পাশাপাশি তিনি দু’টি রাম ছাগলও পালন করেন বলে জানান।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্পের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সনাতনী/প্রচলিত চুলা ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানি পুড়িয়ে যতটুক তাপশক্তি পাওয়া যায় তার শতকরা ৫ থেকে ১৫ ভাগ কাজে আসে । বাকি ৮০-৮৫ ভাগ তাপশক্তি অপচয় হয়। এ ছাড়াও চুলায় সৃষ্ট বিষাক্ত গরম গ্যাস কার্বন মনোঅক্রাইড ভাসমান অদহনকৃত কণা এবং ধোঁয়া ব্যবহারকারীর স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর বলে ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে পরিবেশ দুষণের জন্য এসব ভাসমান ধোঁয়া অনেকটাই দায়ি বলে জানান গবেষকরা। গবেষণায় বলা হয়, নি¤œ আয়ের পরিবারগুলো যারা নি¤œমানের চুলায় জীবাশ্ম জ¦ালানি ব্যবহার করে রান্নাসহ অন্যান্য কাজ করেন তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যহীনতার হার বেশি এবং এমনকি অনেকে অকালে মৃত্যুবরণ করেন এসব ক্ষতিকর ধোঁয়ায় দীর্ঘ প্রতিক্রিয়ার ফলে।
নিম্ন মানের চুলায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের এই কুফলতা সম্পর্কে গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ জানেন না। তবে দেশে এখন কিছু স্বেচ্ছাব্রতী মানুষ, সরকারি-বেসরকারি কিছু সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠান নিরলসভাবে মানুষের জন্য কাজ যাচ্ছে এবং নিম্ন মানের চুলা ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। জ্বালানি সংকট মোকাবেলা ও পরিবেশ রক্ষায় সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে যাচ্ছে। এসব ব্যক্তি ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরন্তর উদ্যোগের কারণে মানিকগঞ্জ জেলার পূর্ব মেতুরার (কালীবাড়ি) আলমগীর হোসেনসহ অনেকের জীবনে নিয়ে এসেছে, কমিয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও!