মর্জিনাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে হবে
সিলভানুস লামিন
রাজশাহী তানোরের বোম ফুটি মর্জিনা। স্বাধীনতার পর মর্জিনা এলাকার মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছেন ‘বোম ফুটি’ নামে। ১৯৭১ সালে বোমার আঘাতে উড়িয়ে গেছে তাঁর বাম পা ও বাম হাতের একটি আঙুল। শুধু তাই নয়; উড়ে গেছে তাঁর বুকের একটি অংশও। ফেলে রাখা বোমা বিষ্ফোরণে মর্জিনার শরীরকে শুধু ক্ষত বিক্ষত করেনি; নিজের নামটিও সকলের কাছে ঢাকা পড়েছে। সহায় সম্বলহীন মানুষটি ছোটবেলা থেকেই জীবন অতিবাহিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন ভিক্ষার পথ। অথচ তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে এই বলে তিনি এতদিন গর্ব করতেন যে, দেশের স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর প্রত্যক্ষ অবদান ছিলো। যদিও বিনিময়ে রাষ্ট্রের কাছে তিনি কোনকিছু চাননি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও তিনি অন্য মুক্তিযোদ্ধার মতো সুযোগ-সুবিধা বা স্বীকৃতি কোনটিই পাননি। এছাড়া দেশের স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর যে বড় ভূমিকা ও অবদান ছিলো সেই বিষয়টিও দেশের মানুষ জানতে পারেননি। তারপরও কোন অভিযোগ নেই মর্জিনার। নিজের মতো করেই এতদিন দিনাতিপাত করেছেন; দারিদ্রতা ও অভাবকে নিত্যসঙ্গী করে। তবে চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি বারসিক নিউজে ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে এটাই বড় কথা’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশের পর থেকে ‘বোম ফুটি মর্জিনা’র জীবন কাহিনী কিছুটা হলেও অন্য মোড় নিয়েছে। মানুষ জানতে পারছেন তার আত্মত্যাগ ও অবদানের কথা। এ সংবাদটি পড়ে তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাঃ শওকাত আলী নিজে তাঁকে অফিস কক্ষে ডেকে তাঁর জীবনের কথা শুনেন। ওই সময় তিনি মর্জিনার কাছ থেকেই তাঁর করুণ জীবন ইতিহাস জানতে পারেন। মর্জিনার কাছ থেকে তাঁর জীবনের করুণ কাহিনী, অস্বীকৃতি ও বঞ্চনার কথা শুনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁকে এক বান্ডিল ঢেউটিন ও তিন হাজার টাকা প্রদান করেন যাতে করে মর্জিনা কিছুটা হলেও নিজের মাথা গোজার ঠাঁই পান।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভুদ্যয়ের পেছনে মর্জিনার মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধা আত্মত্যাগ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ স্বীকৃতি পেয়েছেন, রাষ্ট্রের নানান সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছেন এবং সুন্দর একটি জীবন অতিবাহিত করেছেন। আবার অনেকেই আছেন যারা এখনও তাঁদের এ মহান আত্মত্যাগের কোন স্বীকৃতি পাননি। এদের মধ্যে কেউ কেউ মানবেতর জীবনযাপন করছেন, কোনমতে বেঁচে আছেন। ‘বোম ফুটি’ মর্জিনা তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর থেকে ৪৫টি বছর অতিবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূত উন্নয়ন সাধন করেছে; অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নও সাধিত হয়েছে। দেশে এখন শিক্ষার হার বেড়েছে, বেড়েছে মানুষের আয়, ক্রয়ক্ষমতা, নির্মিত হয়েছে নানান অবকাঠামো ও পরিকাঠামো, রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে যোগাযোগ অবস্থা ও ব্যবস্থা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু যাঁদের রক্তের বিনিময়ে, আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই রাষ্ট্রটি স্বাধীন হয়েছে, আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নিজের পরিচয় গর্ব করে তুলে ধরতে পেরেছি অন্যদের কাছে তাদেরকে ভুলে গেলে এসব অর্জন বৃথা হয়ে যাবে।
‘বোম ফুটি’ মর্জিনাকে আজ তানোরবাসী থেকে শুরু করে রাজশাহী এমনকি দেশের অন্য প্রান্তের মানুষ চিনতে পারছে শুধুমাত্র একটি লেখনির মাধ্যমে। ‘বোম ফুটি’ মর্জিনা গত ৪৫টি বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরে নিজেদের জীবন চাকাকে সচল রাখার চেষ্টা করে গেছেন। তখন কারও চোখেই এ নারীকে জানার ও বোঝার চেষ্টা করা হয়নি। দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনের সবটুকু বিলিয়ে যিনি এতটা আত্মত্যাগ করতে পেরেছেন তাঁকে তো স্যালুট জানানোর দরকার ছিলো। বারসিকনিউজ-এ তাঁর আত্মত্যাগের কাহিনী তুলে ধরতে পারায় আমরা গর্ববোধ করছি। আমরা আরও বেশি আনন্দিত হয়েছি এজন্য যে, বারসিকনিউজ প্রকাশিত একটি ফিচারের মাধ্যমে এই নারী জীবনে কিছুটা হলেও আশা দেখতে পেরেছেন। কেননা এ ফিচার প্রকাশিত হওয়ার পর তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁর খোঁজন নিয়েছেন, সাধ্যমতো সহযোগিতা করছেন। বোম ফুটি মর্জিনাকে তাঁর বাকি জীবনকে পরিচালনা করতে উৎসাহিত করেছেন এবং সাহস যুগিয়েছেন। বারসিকনিউজ-এর পক্ষ থেকে তাই আমরা তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকেও কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাই। এত ব্যস্ত থাকার মধ্যেও তিনি ‘বোম ফুটি’ মর্জিনাকে নিয়ে এ ফিচার পড়ার জন্য এবং মর্জিনার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য। আমরা আশা করবো, আরও প্রতিষ্ঠান, সরকারি বা বেসরকারি, সহুদয় ব্যক্তি এই দুঃস্থ নারীর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়াবেন। তাঁকে সম্মানের আসনে আসীন করবেন। আমরা আশা করি, এভাবেই আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে অবহেলিতভাবে বেঁচে থাকা ও পড়ে থাকা মর্জিনার মতো আত্মত্যাগী এবং মহৎ ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের স্বীকৃতি ও সহযোগিতা করতে পারবো। সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে তাঁদের ভূমিকা ও অবদান সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাঁদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে পারবো।
বারসিকনিউজ সবসময়ই মনে করে শুধু বড় নামই নয়; ছোট্ট ছোট্ট নামগুলোও সংবাদের উপাদান হতে পারে। কেননা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি এবং মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বড় নামগুলোর পাশাপাশি ছোট্ট নামগুলোও সমান অবদান রাখে। মর্জিনার মতো হয়তো আরও অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যারা তাদের আত্মত্যাগ বা কর্মযজ্ঞেরা মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্র উন্নয়নে নিভৃতে অবদান রাখছেন। তাদেরকে উৎসাহিত করতে এবং তাদের মহৎ উদ্যোগকে প্রসার ও প্রচার করার জন্য তাই আসুন আমরা মর্জিনাদের অবদানকে স্বীকৃতি জানাই।