মা আসার অপেক্ষায় থাকি
কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা
১৪ মে কলমাকান্দা উপজেলার মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মা দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে, দেখি ঐ স্কুলের প্রত্যেক শিশু শিক্ষার্থীদের কোলে নিয়ে হলরুম আলোকিত করে বসে আছে কয়েক শত মা। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আয়োজনে এদিন একই সাথে মা দিবস উদ্যাপন ও প্রথম সাময়িক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হয়। বক্তাবৃন্দ মা দিবসের তাৎপর্য ও নিজ নিজ সন্তানদের সম্ভাবনা নিয়ে স্বপ্ন দেখার বীজ বপন করার এক আশা জাগানিয়া বক্তব্য প্রদান করলেন। এদিন যারা ভালো রেজাল্ট করেছে তাদের মায়েদের উচ্ছ্বাস ও আত্মতৃপ্তি প্রকাশ পাচ্ছিল তাদের মুখের অবয়বে। আর যারা খারাপ রেজাল্ট করেছে তাদের মায়েদের মানসিক কষ্টটাও প্রকাশ পাচ্ছিল তাদের মলিন মুখে। তবে প্রত্যেক মা-ই আশান্বিত ছিল যে, পরবর্তী পরীক্ষার জন্য আরো ভালো করে প্রস্তুত করবে নিজ নিজ সন্তানদের। এই ধরনের বিন্দু বিন্দু প্রত্যাশা ও স্বপ্নগুলোই সন্তানের সাথে মায়ের সম্পর্ককে আরো নিবিড় ও আন্তরিক করে তোলে। প্রত্যেক শিশু তার মায়ের আদর, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসার সান্নিধ্য লাভ করবে, ধীরে ধীরে মায়ের চোখের সামনে বেড়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম বলে জানি। কিন্তু এই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক নিয়মগুলো কি সব সময় সব শিশুর জন্য স্বাভাবিক থাকে?
কথা হয় কলমাকান্দা সদর ইউনিয়নের বিশারা গ্রামের প্রবাসী মায়ের সন্তান ছোট্ট অনিক মিয়ার (৪) সাথে। সে বিশারা রেজিস্টার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণীতে আসা যাওয়া শুরু করছে কেবল। পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনার জন্য তার মা অজুদা বেগম (২৮) তার ৩ ছেলেকে রেখে জর্দানে অবস্থান করছেন প্রায় ৩ মাস যাবৎ। ৩ ছেলের মধ্যে অনিক মিয়া সবার ছোট। তারও পূর্বে অনিকের ৩ বছর বয়সে সৌদি আরবে ছিল প্রায় ৬ মাস। মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই অত্যন্ত পবিত্র, নির্মল চেহারার চোখ দু’টি ছল ছল করে উঠল। সে জানাল, রাত হলেই মায়ের কথা খুব বেশি মনে পড়ে তার। মাসে দুই কি তিনবার কথা হয় মায়ের সাথে। মা দিবসে মায়ের স্নেহ, আদর ও ভালোবাসার স্পর্শ ও সান্নিধ্য পাওয়া তো দূরের কথা! মা দিবসের ঠিক দুই সপ্তাহ পূর্বে একবার মায়ের সাথে কিছুক্ষণের জন্য কথা হয়েছিল তার ও তার বড় দুই ভাইয়ের। তার বাবাসহ তারা প্রত্যেকেই তার মামীর বাড়িতে আছে। এখানে অনেকগুলো সমবয়সী থাকায় সারাদিন মায়ের সান্নিধ্য পাবার আকঙ্খা আড়াল হয়ে থাকে। কিন্তু রাতের নির্জনতা মায়ের শুন্যতা আকড়ে ধরে তাদের। বাবা সারাদিন বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় তার হাত ধরে স্কুলে নেওয়া, তাকে যতœ করে খাওয়ানো, ভালো রেজাল্ট করার জন্য তাকে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখা, তার রুচি অনুসারে খাবার দেওয়া, ঘুম পাড়ানো সব কিছুই যেন এলোমেলো। ভাবার বিষয় হচ্ছে, যা কিছু সে আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে পাচ্ছে সেটা কি তার পছন্দ, রুচি ও চাহিদা অনুসারে পাচ্ছে? মা ছাড়া যা কিছু পাচ্ছে সেটা কি তার শারীকি ও মানসিক বিকাশের জন্য যথেষ্ট?
অনিকের প্রতিবেশী ও আত্মীয় কামরুল ইসলাম (১৩)। ৭ম শ্রেণীতে পড়াশুনা করছে কলমাকান্দা মাদ্রাসায়। তারাও তিন ভাই দাদীর কাছেই আছে। নয় মাস পূর্বে তার সবার ছোট ভাইয়ের বয়স যখন ৩ বছর, তখন তার মা সৌদি আরবে চলে গেছে গৃহকর্মী হিসেবে। সেই থেকে শুধু মোবাইলে কথা হয়। মা দিবসে মায়ের সাথে কি কথা হলো জানতে চাইলে, ছল ছল চোখে বলে, “মা দিবস সম্পর্কে জানি না। তবে মাকে সবসময় কাছে পাইতে চাই। কিন্তু চাইলেই তো আর হয় না। ইচ্ছে করলেই সেও আইতে পারে না। আবার আমরাও যাইতে পারিনা। অন্য দেশ যে। কবে আইব তাও জানি না। খালি মায়ের আসার অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নাই।”
আবার অনেক মা আছে নিজ দেশের ভেতরেই ছোট ছোট কোলের শিশুদের রেখে শহরমূখী হচ্ছেন জীবিকার তাগিদে। মায়ের কোল ছাড়া এমন অনেক শিশুদের দেখা যায় প্রায় প্রতিটি গ্রামেই। দেখা হয়, রংশিংপুর গ্রামের উমা সরকার (৫) এর সাথে। সে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। দুই বোনের মধ্যে উমা ছোট। বড়টার বয়সও ছয় কি সাত হবে। তাদেরকে প্রবীণ বিধবা দাদীর কাছে রেখে তাদের মা উমা সরকার ও বাবা সুকুমার সরকার দুইজনই ঢাকায় গার্মেন্স ফেক্টরিতে কর্মরত প্রায় এক বছর যাবৎ। তারা প্রতিমাসে যা টাকা পাঠায় তা দিয়েই কোন রকমে তাদের লালন পালন করছে। ছোট শিশু দু’টি মায়ের সান্নিধ্য লাভ করে বছরে কেবল এক কি দুইবার।
বাস্তব জীবনের স্বাভাবিকতা অনিচ্ছা স্বত্বেও উপেক্ষা করে যেসব মা ও সন্তানেরা বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করছেন, তাদের আত্মিক বন্ধন আরো সুদৃঢ় হউক, স্বপ্ন ও শ্রম সার্থক হউক। মা যেখানেই থাকুক বটবৃক্ষের মত তার সুশীতল ছায়া সন্তানদের জীবনে প্রশান্তি বয়ে আনুক। অব্যক্ত কষ্ট প্রশমিত হউক। স্বাভাবিক থাকুক এগিয়ে চলা।