বাড়ির ডাক্তার নিমগাছ

রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম শহিদ

ডাক্তার আসে চিকিৎসা দিয়ে চলে যায়। ঘরের ডাক্তার নিমগাছ রোপণ করলে আর কখনো যায় না। প্রতিনিয়ত সেবা দিয়েই যায়। তাই এসব সেবা ও গুনাগুণ জানা জরুরি। বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন পতিত ও পড়ে থাকা জায়গায় অবহেলায় জন্মে থাকে এই নিমগাছ। সৃষ্টিকর্তা নিম গাছের সর্বাঙে দিয়েছেন এক ধরনের তিতা স্বাদ, যার ফলে মানুষ যতœ বা পরিচর্যা না করলেও গবাদি পশুসহ অন্যান্য প্রাণী খেতে ও নষ্ট করতে পারেনা। একা একা নিজের প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েই বেড়ে উঠে গাছটি। এ অঞ্চলের বিভিন্ন পাখি নিমের ফল খায় আর বীজ যেখানে সেখানে ফেলে দেয়, সেখান থেকেই জন্ম নেয় এক একটি নিমগাছ। একটি বাড়ির সামনে নিম গাছ থাকলে সে বাড়ির মানুষের জ্বর কম হয় এবং নিমগাছের বাতাস শরীরে লাগলে শরীর ভালো থাকে। গরমের দিনে নিম গাছের বাতাস তুলনামুলক বেশি ঠান্ডা ফলে আমাদের শরীর ঠান্ডা রাখে।

IMG_20160628_154929
নিমগাছ মানব জীবনে তথা সকল প্রাণী কুলের বিভিন্ন ধরনের উপকারে আসে। অতিতে নিমগাছ ও বীজের ব্যাপক ব্যবহার থাকলেও বর্তমানে তেমনটি আর চোখে পড়েনা। আগের দিনে মানুষ নিমের ব্যবহার করলেও বর্তমানে পুরোনো কালচার ভেবে এখন এটি ব্যবহার করতে দেখা যায় না। নিমের বিকল্প ব্যবহার হিসেবে বিভিন্ন রকমারি পণ্য মানুষের হাতে চলে এসেছে। মানুষ টাকার বিনিময়ে তা ক্রয় করে ব্যবহার করছে।

নিমের প্রকার ভেদ
এলাকায় দুই ধরনের নিম গাছ দেখা যায় দেশী নিম ও ঘোড়া নিম। ঘোড়া নিম সম্পর্কে উপকারিতার কথা তেমন বলতে দেখা যায় না শুধু কাঠ দিয়ে আসবাবপত্র তৈরি করতে দেখা যায়। তবে সাধারণত নিম বলতে দেশী নিমের উপকারিতার কথা বলতে দেখা যায়।

নিমের উপকারীতা
নিমের পাতা সরিষার তেলে ভাজি করে খেলে পেটে গুড়া কৃমি থাকেনা। ধান, সরিষা, গম ও ভূট্টাসহ বিভিন্ন বীজ সংরক্ষণের সময় বীজের সাথে নিমের পাতা মিশিয়ে রাখলে কোন ধরনের পোকা আক্রমণ করতে পারেনা। বাড়িতে খাবারের চাল সংরক্ষণ করার সময় নিমের পাতা দিয়ে রাখলে শোরা পোকা চালের মধ্যে আসতে পারেনা। চুলকানি পাচড়া জাতীয় ঘা যদি শরীরে হয় তাহলে নিমের পাতা পানিতে ফুটিয়ে ঘা পরিষ্কার করলে সেই ঘা তাড়াতাড়ি ভালো হয়। গ্রামের মানুষ জানান, গরু, মহিষ ও ছাগলের শরীরে কোন ক্ষত সৃষ্টি হলে নিমের পাতার গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নিমের তেল লাগালে সেখানে কোন মাছি বসতে পারেনা ও তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে। অনেকক্ষণ রোদে পুড়লে তার পর যদি নিমের ছাল, গিমার শাক, পেঁয়াজ একসাথে বেটে খেলে রোদ পোড়াভাব কেটে যায়। নিমের লাল ছালের নিচে যে সাদা ছাল রয়েছে সেই সাদা ছাল বা বাকল বেটে তারপর ছেকে খেলে বসন্ত রোগ ভালো হয়। হলুদ ও নিমের পাতার রস একসাথে করে খেলে শরীর মসৃণ থাকে ও খাবারে রুচি হয়। শরীরের ভেতরে জ্বর থাকলে নিমের ছাল বেটে রস করে সকালে খালি পেটে তিন দিন খেলে হাড়ের ভিতরের জ্বর ভালো হয়ে যায়। নিমের ফলের ভেতরের লাল অংশ, লং মসলা ও মান গাছের শিকড় একসাথে বেটে খেলে গলাচিপা/ গলাহারি রোগ ভালো হয় এবং মুখ দিয়ে লাল পড়া বন্ধ হয়। পাকা নিমের ফল পাখির প্রিয় খাবার, অনেক ছেলে মেয়েরাও পাকা ফল চুষে খেতে ভালবাসে।

IMG_20170925_141416

নিমের ডাল দিয়ে দাতন করলে দাঁতে পোকা লাগেনা, দাঁতের গোড়া ফোলেনা, পুঁজ ধরেনা, মাড়ি শক্ত থাকে এবং মুখে গন্ধ হয় না। গ্রামের মানুষেরা আরও জানান, শরীরে ঘামাচি হলে ভালো করে ফিটকিরির পানি দিয়ে ধুয়ে তারপর হলুদ ও নিমের পাতার মিশ্রণ শরীরে মাখলে ঘামাচি ভালো হয়ে যায়। নিমের তেল মাখায় দিলে মাথা ঠান্ডা থাকে,উকুন হয়না, গরুকে মাখালে আঠল পোকা থাকেনা, গরু/মহিষের শিংয়ে দিলে শিং মশৃণ হয়, মাথা ঠান্ডা থাকে ও সর্দিকাশি ভালো হয়। মহিষের গায়ে মাখলে গায়ের খুকশি ও উকুন মরে যায়। গরু, মহিষের গাড়ির চাকাতে দিলে গাড়ী সহজে চলে। অনেক সময় মিটসেফ এর মধ্যে খাবার রাখলেও পিপড়া উঠে তাই মিটসেফের খুরাতে নিমের তেল দিয়ে রাখলে পিপড়া উঠতে পারে না। দোলনা ঝুলানোর সময় দোলনার হুকটিতে নিমের তেল দিয়ে রাখলে পিপড়া/অন্যান্য পোকা দড়ি দিয়ে দোলনাতে আসতে পারেনা এবং বাচ্চার শরীরের কোন ক্ষতি করতে পারেনা। শোয়ার ঘরে খাট/চৌকির খুরাতে নিমের তেল দিয়ে রাখলে বিছানায় ছারপোকা, পিপড়া ও অন্যান্য পোকা উঠতে পারে না। নিমের খিল কুড়িয়ে বসায় রাখলে খাওয়ার পর দাঁতে খিলন করা হয়। নিমের কাঠ অনেক শক্ত। এছাড়া তিতা হওয়ার কারণে কোনদিন ঘুন পোকা লাগেনা। তাই মানুষ সংসারের বিভিন্ন আসবাবপত্র বানিয়ে থাকে যেমন-খাট, চৌকি, ড্রেসিং,আলমারী, শোকেজ, চেয়ার, টেবিল, ঘরের তীর, দরজা ও জানালা। নিমের তৈরি আসবাবপত্র দীর্ঘস্থায়ী হয়। তাই কাঠের দামও বেশি। এমন উপকারিতার কথাগুলো জানালেন তানোর উপজেলার গোকুল মথুরা গ্রামের কৃষক লালচাঁন (৫৮)। একই গ্রামের জিতেন্দ্রনাথ সুত্রধর (৫৪) জানান, ‘নিমের খৈল যে কোনো গাছের ১/২ ফিট দূরে মাটি আলগা করে মিশিয়ে দিলে গাছে পোকা লাগেনা এবং উর্বরতাবৃদ্ধি পায়। ধানের জমিতে নিমের খৈল ব্যবহার করলে পাউস/গৌবর সারের কাজ করে ও জমিতে কীটনাশক দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। পানের বরজে নিমের খৈল দেয়া জরুরি কেননা সেখানে বেশি কীটনাষক প্রয়োগ করা যায় না, মানুষ সরাসরি পানের পাতা খাওয়ার জন্য গ্রহণ করে থাকে।’

অতীত ব্যবহার
অতীতে বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রত্যেক বাড়িতে নিমের তেল রাখতেন নিজের প্রয়োজনে তারা নিমের বীজ সংগ্রহ করতেন। সেই বীজ রোদে শুকাতেন তারপর চাড়িতে খোলা দিয়ে ঘুষে উপরের অংশ উঠে নিয়ে নিচের লাল অংশ বের করতেন। তারপর আবার রোদে শুকিয়ে এলাকায় গরু দ্বারা চালিত কাঠের ঘ্যানে ভাঙার পর সেখান থেকে নিমের তেল ও খৈল সংগ্রহ করতেন। সেই তেল সংসারের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতেন ও খৈল জমিতে ব্যবহার করতেন।

সংকট
বর্তমানে বরেন্দ্র অঞ্চলে মানুষের বাড়িতে নিম তেল খুজে পাওয়া কঠিন। কারণ এর ব্যবহার আর চোখে পড়ে না। গরু দ্বারা চালিত IMG_20170925_141428ঘ্যান আর এ অঞ্চলে একটিও নেই। মেশিন দিয়ে কিছু ভাঙাতেন কিন্তু মেশিনের ভিতর তিতা স্বাদ লেগে যেতো তাই মেশিনে অন্য তেল বীজ ভাঙালে তিতা হয়ে যায়। অন্য তেল বীজ ভাঙানো সমস্যার জন্য মেশিন মালিকরা আর নিম বীজ ভাঙাতে চায় না। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে নিমের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। যদিও কেউ প্রয়োজন মনে করে তাহলে ২০-৩০ কি: মি: দুর থেকে নিম বীজ ভাঙিয়ে তেল সংগ্রহ করতে হয় অনেক সময় ফিরেও আসতে হয়।

পরিশেষে বলা যায়, নিমের হাজারো গুণ আছে যা এখানে সব গুলো উঠে আসেনি। এটি পরিবেশ উপযোগি উপকরণ হলেও বর্তমানে নিমের ব্যবহার একেবারেই কমে যেতে দেখা যায়। এককভাবে তা রক্ষা করাও কঠিন। নিমের উপকারিতা সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে তথ্য আদান প্রদানের নেই কোন উদ্যোগ। এ সম্পর্কে আমাদের প্রবীণদের লোকায়ত যে জ্ঞান আছে সেটা সংরক্ষণ ও ব্যবহারে প্রচার প্রচারণার পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। তাহলে আমাদের নতুন প্রজন্মরা সেসব তথ্য সহজেই জানতে পারবে। সম্মিলিতভাবে নিমের উপকরণ ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া যায়। সরকারি ও বেসরকারিভাবে এসব সামগ্রি তৈরি করতে ও সহজভাবে পাওয়ার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আবার ফিরে আসতে পারে পরিবেশবান্ধব এই নিমের ব্যবহার।

happy wheels 2

Comments