ঘিওরে তেরশ্রী গণহত্যা দিবস পালিত
আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ)॥
মানিকগঞ্জ ঘিওর উপজেলায় যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে তেরশ্রী গণহত্যা দিবস। দিবসটি উপলক্ষে গতকাল বুধবার সকালে নিহতদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এর আগে সেখান থেকে একটি শোক র্যালি বের করা হয়। র্যালি শেষে স্মৃতিস্তম্ভের সামনে অুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা।
শহীদ স্মৃতি পরিষদের সভাপতি ও পয়লা ইউপি চেয়ারম্যান মো. হারুন অর রশীদের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ ও জাতীয় ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক এ এম নাঈমুর রহমান দুর্জয়, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডঃ গোলাম মহিউদ্দিন, জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি এ্যাডঃ আব্দুল মজিদ ফটো, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডঃ আব্দুস সালাম পি পি, সাবেক সাংসদ মফিজুল ইসলাম খান কামাল, জেলা কমিউনিষ্ট পার্টির সাবেক সভাপতি এ্যাডঃ আজহারুল ইসলাম আরজু, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) সৈয়দা সামিরা, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মো. মমিন উদ্দিন খান, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার আঃ আজিজ, ডেপুটি কমান্ডার কে এম সিদ্দিক আলী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম মিন্টু, শহীদ স্মৃতি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক স্বমেশ^র প্রসাদ রায় চৌধুরী, অপরদিকে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এস এ জিন্নাহ কবির, দৌলতপুর উপজেলা চেয়ারম্যান তোজাম্মেল হক তোজা, জেলা যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী রায়হান উদ্দিন টুকু, পৌর বিএনপি সভাপতি নাসির উদ্দিন আহম্মেদ যাদু, জেলা যুব দলের সাবেক যুগ্ন আহবায়ক কাজী মোস্তাক হোসেন দীপু ।
২২ নভেম্বর তেরশ্রী ট্য্রাজেডি দিবস। দিনটি মানিকগঞ্জবাসীর কাছে এক কলঙ্কিত দিন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী বাজারসহ ৪টি গ্রামের ঘুমন্ত মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে এবং পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে হত্যা করে ৪৩ জন নিরাপরাধ মানুষকে। বর্বর এই হত্যাকান্ডের বিচার না পাওয়া মানুষের দীর্ঘশ্বাস এখনো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। ওই দিনে প্রতিটি দূঃসহ যন্ত্রণা এলাকাবাসীর বুকে এখনো বিধে আছে।
ঘিওর উপজেলা সদর থেকে ৩ কিলোমিটার ভেতরে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূতিকাগার তেরশ্রী বাজার, তেরশ্রী গ্রাম, সেন পাড়া, বড়ুরিয়া ও বড়বিলা এক শান্ত গ্রাম। পল্লী গ্রাম হলেও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলনে যথেষ্ট সক্রিয়তা ছিল এ গ্রামবাসীর। সচেতন গ্রামবাসীর কারণে এ গ্রামে গড়ে উঠেছিল মানিকগঞ্জ জেলার প্রথম কলেজ। আর এ কলেজকে কেন্দ্র করে পশ্চাৎপদ চেতনার কিছু অপশক্তির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতায় বিভেদ সৃষ্টি করা হয়। এই প্রতিহিংসাই চরিতার্থ করে ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর। নর পিচাশরা হানাদার বাহিনীর সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে শীতের কুয়াশা ঘেরা ঘুমন্ত পল্লী¬তে চালায় ৬ ঘণ্টার নরকীয় হত্যাযজ্ঞ, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় গ্রাম থেকে গ্রাম। হানাদাররা ব্যবহার করে স্বয়ংক্রীয় অস্ত্র। এই বিভীষিকাময় দিনটিতে তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানসহ ৪৩ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় তেরশ্রীর জমিদার সিদ্ধেশ্বর প্রসাদ রায় চৌধুরীকে। আজও জেলাবাসী এ ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছে। প্রতিবছর দিবসটি ঘটা করে পালিত হলেও বিচার হয়নি ঘাতকদের।
২২ নভেম্বর ভোরে সেন পাড়ার ১০ মাসের সন্তান সম্ভবা রেভা রানী দত্ত সেদিন হারান তার স্বামী ও শশুরকে। তাদেরকে হাত পা বেঁধে বেনয়েট দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে হত্যা করা হয়। বাড়ি ঘেরাও করে স্বয়ংক্রীয় অস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালায় হায়েনারা। পুড়িয়ে দেয়া হয় তার সুখের সংসার। বেঁচে যাওয়া রেভা রানী পরেরদিন পুত্র সন্তান জন্ম দেন খড়ের গাদায়। আজও বিচার হয়নি সেই সমস্ত হায়েনা এবং দোসরদের। এত ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা তাকে দেয়নি কোন শান্তনা। এমনকি তিনি শহীদ পরিবার হিসাবে পায়নি কোন স্বীকৃতি কিংবা একটি বৃদ্ধ ভাতার কার্ড।
মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান সেদিনের হায়েনাদের দোসর পিচ কমিটির সভাপতি শাহাদাত হোসেন ফকির, সাধারণ সম্পাদক মানিক ভূঁইয়া এবং পিচ কমিটির নেতা আব্দুর রাজ্জাক ভোটনের নেতৃত্বে এই হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়েছে বলে জানান। মানবতা বিরোধী এই হত্যা কান্ডের বিচারেরও দাবি জানান তিনি।
শহীদদের নামাঙ্কিত স্মৃতিস্তম্ভটি মানিকগঞ্জ-দৌলতপুর সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে পথচারীদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেদিনের বিভৎসময় স্মৃতি। ২০১২ সালে এলজিইডি ২৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের একটি দাবি পূরণ হলেও হত্যাকান্ডে জড়িতদের বিচার না হওয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ রয়েই গেছে।