মানিকগঞ্জে পানের বরজে শীতের হানা
মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক ঃ
দিন দিন কদর বাড়ছে মানিকগঞ্জের সাচি পানের। ইতোমধ্যে দখল করেছে পাকিস্তানের বাজার। প্রতিবছর প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার পান মানিকগঞ্জের বিভিন্ন বরজ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি করা হয়। পান চাষ করে চাষীরা যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন একইভাবে তারা দেশের জন্য আয় করছেন বৈদেশিক মুদ্রা ।
জেলার হরিরামপুর ও শিবালয় উপজেলার এলাকার কিছু সংখ্যক চাষী পান চাষ করেন। তারা পড়াশুনা তেমন না জানলেও পান রপ্তানির খবর রাখেন নিয়মিত। পাকিস্তানের বিমানের ফ্লাইট সিডিউলের খবর রাখতে ভুল হয় না চাষীদের।
পদ্মা তীরবর্তী হরিরামপুরের বাল্লা, মালুচি, কাঞ্চনপুর, রামকৃষ্ণপুর, কুশিয়ার চর, বাহাদুরপুর এবং শিবালয়ের উলাইল, আরোয়ারা এলাকায় এক সময় প্রচুর মরিচ চাষ করা হতো। বর্ষার সময় এ মরিচের প্রচুর দাম পেত কৃষকরা। জমিতে মাটি তুলে ভিটি বেধে উঁচু করে এ মরিচ চাষ করা হতো। পান চাষ বেশ লাভজনক হওয়ায় এ এলাকার প্রায় শতাধিক মরিচের ভিটিতে এখন ব্যাপকভাবে পান চাষ করা হচ্ছে।
কিন্তু লাগাতার শীত ও ঘনকুয়াশার কারণে পান চাষীদের যেন মাথায় হাত। পান গাছে বিভিন্ন রকমের পচন রোগ দেখা দিয়েছে। পানের পাতাপচা, পানে কালো দাগ, ও পান গাছের পাতা ঝড়ে পড়া রোগসহ নানা ধরনের রোগ বালাই ছড়িয়ে পড়ছে পানের বরজে। কুয়াশার কারণে পান গাছের পাতায় কালো দাগ ও হলুদ রঙ ধরেছে। শুকিয়ে যাচ্ছে পানপাতা। সেই সঙ্গে গাছ থেকে ঝরে পড়ছে পান। এতে প্রতিটি পানের বরজ মালিকই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
চলতি মৌসুমে পাকিস্তানে হরিরামপুরের এই সাচি পান রপ্তানি করতে পারবেন কিনা এ নিয়ে শঙ্কিত পান চাষী ও রপ্তানিকারকরা। পাকিস্তানের বাজারে বাংলাদেশ থেকে যে পান রপ্তানি হয় তার ৯০ ভাগই যোগান দেন হরিরামপুরের পান চাষীরা। চলতি মৌসুমে চাষিদের প্রায় অর্ধকোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তারা। এদিকে কৃষি কর্মকর্তারা তাদের দেখভাল করেনা এবং সরকারি কোন অনুদান পান না বলে অভিযোগ করেন পান চাষীরা । এভাবে চলতে থাকলে পাকিস্তানে পান রপ্তানি হুমকির মধ্যে পড়বে।
রামকৃষ্ণপুর গ্রামের পানচাষী মোশারফ হোসেন বলেন, ‘এবার ২ বিঘা জমিতে পানের বরজ করেছিলাম কিন্তু তীব্র শীত ও কুয়াশার কারণে পান গাছে রোগ বালাই হয়ে কালো দাগ হয়ে, পান শুকিয়ে পুরো পানের বরজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এবছর বন্যায় ৪ লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষি ব্যাংক থেকে ১০% সুদে ৯০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে প্রায় ২ লাখ টাকা দিয়ে আবারও পানের বরজ ঠিক করেছিলাম।” তিনি আরও বলেন, “বন্যার সেই ধকলই এখনও কেটে উঠতে পারিনি, এর ওপর এবারে শীতে আমাদের পানের বরজের আবারো ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গেলো, এবার কি করে যে ব্যাংকের এই ঋণ শোধ করবো সেই চিন্তাতেই রাতের ঘুম হারাম করে ফেলেছি। সরকার যদি আমাদের কথাটা বিবেচনা করে আমাদের কিছু বিনা সুধে ঋণ দিতো তাহলে আমাদের অনেক উপকার হতো।” তিনি বলেন, “আপনারা আসছেন তো দেখেন কিছু করতে পারেন কিনা। কারণ গেলো বন্যায় আমাদের পানের বরজ ক্ষতি হওয়ার পরে আমরা হরিরামপুর উপজেলা কৃষি অফিসে গিয়ে লিখিত অভিযোগ দেই। তারা আমাদের সরকারি কিছু সাহায্য সহযোগিতা দেবার কথা বললেও ৪ আনা পয়সাও এখনো পর্যন্ত দেয়নি এবং আমাদের এইখানে এসে কোন প্রকার খোঁজখবর ও নেয়নি।”
আরেক পানচাষি নুরুল ইসলাম বলেন, “আমি ২০ শতাংশ জমিতে ৪০ হাজার টাকা খরচ করে পানের বরজ করেছি, এবছর বন্যায় ও একবার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, তারপরও এইবার আবার পানের বরজ করেছি তবে এই শীতে আবারো প্রায় ১২ আনার ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছি, কেননা পানের গায়ে কালচে দাগ দেখা দিচ্ছে এবং কালচে দাগ হয়ে পান ঝড়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থা চলতে থাকলে আগামী সপ্তাহেই আমার বরজে সব পান ঝরে পড়বে। সারাবছর তো আসেইনা, এখন এই শীতে যে আমাদের এতো ক্ষতি হচ্ছে তাও আমাদের কৃষি অফিস থেকে কোন কর্মকর্তা আসলো না। আমি যে পান গত বছরেও ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি সেই পান এক প্রকার জোর করেই এই বছরে মাত্র ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি।”
স্থানীয় আরেক পুরানো পান চাষী এবং পান বিদেশে রপ্তানিকারক মো. নুরুল ইসলাম (মজনু) জানান, “তিনি ১৯৬০ সাল থেকে পানের ব্যবসা করেন এবং ১৯৭৭ সাল থেকে পাকিস্তানে পান রপ্তানি করেন। একটির পর একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগ লেগেই আছে। অতি বৃষ্টি, বর্ষা, নদী ভাঙন ও বর্তমানে শীতের হানায় পড়েছেন তারা। তিনি এ বছর ৩ বিঘা জমিতে পান চাষ করেছেন। এ পর্যন্ত তাঁর ৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এভাবে শীত পড়তে থাকলে পুরো হরিরামুপরে পান ব্যবসায়ীদের প্রায় অর্ধকোটি টাকা ক্ষতি হবে। তিনি বলেন, “আমাদের এই পানের বরজে প্রতিবছরই শীতের সময় কিছু পান নষ্ট হয়, তবে এবছরের মতো শীতে এবং বন্যায় এতো পান এক সঙ্গে নষ্ট হওয়ার রেকর্ড নেই। আমরা যদি পান চাষ বাদ দিয়ে অন্য কোন আবাদ করি তবে প্রতি বিঘায় প্রায় ৫ লাখ টাকার মাটি ফেলতে হবে। যা বেশির ভাগ পান চাষীদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমি মনে করি কৃষি কর্মকর্তারা যদি আমাদের একটু খোজখবর নিতো এবং কোন উপদেশ দিতো তাহলে আমাদের এতো ক্ষতি হতো না।”
হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী আরেফীন রেজওয়ান বলেন, “পান চাষীরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে কৃষকদের সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”