হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের তৈরি উপকরণ
তানোর, রাজশাহী থেকে অনিতা বর্মণ
রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলায় অবস্থিত গোকুল-মথুরা গ্রাম। এই গ্রামে প্রায় ১৯/২০ জন নারী ২০ বছর ধরে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন ধরনের ঝাকা-ডালি তৈরির মাধ্যমে বাঁশ শিল্পটি ধরে রেখেছেন বলে জানান শ্রীমতি নিভা রানী। তিনি জানান, বর্তমান প্রযুক্তির যুগে বাঁশ শিল্পের তৈরী মনকারা বিভিন্ন জিনিসের জায়গা করে নিয়েছে স্বল্প দামের প্লাস্টিকের তৈরি পণ্য। তাই বাঁশের তৈরি মনকারা সেই পণ্যগুলো এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে । কদর না থাকায় গ্রামগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাঁেশর তৈরী বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় আর্কষণীয় আসবাবপত্র ।
একই গ্রামের শ্রীমতি কামনা রানী বলেন, “সংসারের খরচ যোগাতে পুরুষেরা বিভিন্ন ধরনের কৃষি, ব্যবসার কাজের সাথে যুক্ত থাকেন। তারপরও সংসারের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মত অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। তাই পুরুষদের পাশাপাশি আমরা নারীরা সংসারের কাজ শেষ করে বাঁশ সংগ্রহ করে বাঁশ দিয়ে ময়লা ফেলা ঝাকা, মাছের কোপরা (যে ব্যক্তিরা মাছ বিক্রির জন্য যে ঝাকা ব্যবহার করা হয়), আলু তোলা ঝাকা, ধান চালনা, গরু খাওয়ার চাংগারি, খোলই এই সব বিভিন্ন রকমের পণ্য তৈরি করে থাকি।”
কামনা রানীর কথার ফাকেই, শ্রীমতি মেনোকা রানী বলেন, “দিন দিন বিভিন্ন জিনিসপত্রের মূল্য যেভাবে বাড়ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না এই শিল্পের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের মূল্য। একসময় এই এলাকার ঘরে ঘরে ছিলো বাঁশের তৈরি এই সব পণ্যের কদর।” অন্যদিকে বাঁশের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাঁশ শিল্প আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। যে বাঁশ ১০০/১৫০ টাকায় পাওয়া যেত সেই বাঁশ বর্তমান বাজারে কিনতে হচ্ছে ২০০/২৫০ টাকায়, সে তুলনায় সাথে বাড়ছে না এই সব পণ্যের দাম। জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ ঘর বাড়ি র্নিমাণে যে পরিমাণে বাঁশের প্রয়োজন সে পরিমাণে বাঁশের ঝাড়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে না ।
গোকুল-মথুরা গ্রামের মো. বিরু মামা এই বাঁশ তৈরি পণ্য তৈরী করতেন খুব সুন্দর করে। তাঁর হাত ধরেই নারীদের এই কাজটি শিখা। তিনি এই পাড়ার নারীদের শিখাতেন কিভাবে বাঁশ দিয়ে তৈরি করতে হয় সংসারে ব্যবহার করা বিভিন্ন প্রকারে বাঁশের উপকরণ। প্রথমত শিখতে খুব কষ্ট হতো, কখনো কখনো বাঁশকে উপকরণ তৈরির উপযুক্ত করতে গিয়ে হাঁত কেটে রক্তও বের হতো বলে জানান শ্রীমতি সুনেতা রানী। তিনি বলেন, আজ থেকে ২০ বছর ধরে এই কাজটি করছি। দিনে ২/৩টি ডালি তৈরি করা যায়। আর এই ডালি বিক্রি করে মাসে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা আয় করা যায়। আমাদের এই উর্পাজনের টাকা দিয়ে সংসারের টুকিটাকি জিনিস ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে খরচ করা হয়।”
একই গ্রামের মোসা: ফাহিমা বেগম বলেন, “২৩ বছর আগ থেকে সাজি, সরপোষ (ঢাকনা) এই সব বাঁশের উপকরণ তৈরি করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে আসছি। সংসারে সব কাজ বজায় রেখে অবসর সময়ে এই কাজটি করে থাকি। অনেক কাজ একসাথে করে হাটে বিক্রি করা হয়। কখনো কখনো গ্রামের নারীরাই বাড়ি থেকে কিনে নিয়ে যান।”
আলু তোলার সময় ডালির চাহিদা বেশি হয় বলে জানান, শ্রীমতি শান্তনা রানী। কিন্তু বাঁশের দাম বেশি হওয়ার কারণে চাহিদা অনুযায়ী ডালি তৈরি করতে পারেন না। তিনি জানান, নারীরা বাঁশঝাড়ের মালিক এর পরিবারে যতটা ডালি বা ঝাকার প্রয়োজন হয় সে সংখ্যক ডালি বা ঝাকা দিয়ে বাঁশ সংগ্রহ করেন মালিকদের বাঁশঝাড় থেকে। সে বাঁশ দিয়ে তাঁরা ঝাকা, ডালি তৈরি করে ব্যবহার করার পাশাপাশি বিক্রি করেন। এত তাঁরা কিছুটা বাড়তি আয় করতে পারি বলে জানান। আবার কখনো মজুরি হিসেবেও কাজ করা হয়। একটি ডালি তৈরি করে ডালির ধরণ অনুযায়ী (বড় মাপের) ২০০/২৫০ আবার ছোট মাপের ডালি তৈরী করে ৫০/৬০ টাকা ও আয় করা হয় বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, “যদি সহজ মূল্যে বাঁশ ক্রয় করা যেত তাহলে এই গ্রামের নারীরা নিজেদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার পাশাপাশি এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হতো।”