হাওরবাসীদের জীবন সংস্কৃতি ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
:: কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা
জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতি
আফাল একটি স্থানীয় শব্দ। যার অর্থ ঢেউ। হাওরবাসীর জীবন জীবিকায় আফালের রয়েছে নিজস্ব আখ্যান। এখানে বিশেষভাবে মৎস্যনির্ভর হাওরের জনগোষ্ঠীর কথা তুলে ধরা হয়েছে। নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলায় ৮টি ইউনিয়নে প্রায় ৩৪৬টি গ্রাম (তথ্যসূত্র: উপজেলা পরিসংখ্যান অফিস), ৫ (মশিউড়া, বড় হাওর, গোড়াডোবা,জাংরিয়া, মেদী) টি হাওর এবং প্রচুর নদী, নালা, খাল ও বিল রয়েছে। হাওরের ভূমি বৈশাখ মাসের বোরো ফসল কৃষককে উপহার দিয়ে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির জলে অবগাহনের মধ্য দিয়ে শুরু করে জল সঞ্চয়। পাহাাড় ঢলের পানি, খাল, বিল, নদী ও নালার পানির মিলনের ফলে হাওর ধীরে ধীরে রূপ নেয় বিশাল জলরাশির। কাদা মাটির সাথে লেগে থাকা পানির উচ্চতা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২০-২৫ ফুট পর্যন্ত। শুরু হয় আফালের (ঢেউয়ের) খেলা। বৈশাখ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত আফাল স্বরূপতার উন্মোচন ঘটিয়ে হাওরের জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকায় এনে দেয় নবমাত্রা। হাওর নির্ভর সংস্কৃতি পরিচালিত হতে থাকে আফালের সাথে অভিযোজিত হয়ে।
হাওরের অতি সাধারন জনগোষ্ঠী আটিবদ্ধভাবে বসবাস করে। ঘরবাড়িগুলো তৈরি করে এক পরিবারের ঘরের সাথে আরেক পরিবারের ঘরের সাথে একদম লাগালাগিভাবে। যেন বৃষ্টির পানিতে বসতভিতের মাটি ক্ষয়ে না যায়। বসতভিটে রক্ষার্থে উজাউড়ি ও কড়চ বৃক্ষ রোপণ করেন তারা। উজাউড়ি শুধুমাত্র বসতভিটে রক্ষা করার জন্যই ব্যবহৃত হয় না; এটি হাওরবাসীর সারাবছরের জ্বালানিরও যোগান দেয়। যাদের গরু আছে তারা আবার উজাউড়ি ও গোবর দিয়ে মোটা তৈরি করে জ্বালানি হিসেব ব্যবহার করেন। এতে লাকড়ি সাশ্রয় হয় অনেক। উজাউড়ি ও গোবর হাওরবাসীর লাকড়ির অন্যতম উৎস। বছরের ছয় মাস জলের নীচে থাকা রাস্তাঘাট, নদীরপাড়, জমির আইল, হাওরের পাড় রক্ষা করে চলেছে প্রাকৃতিকগতভাবে জন্মানো উজাউড়ি। হাওরের মাঝখানে উজাউড়ি গাছের পাতার নীচে বাস করে কিছু নাম না জানা পোকামাকড় ও মাকড়সা। সেগুলো পাখিরও খাবারের যোগান দেয়। এই গাছের ঝুপে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কলমি শাক হাওরবাসীর খাদ্য ও পুষ্টির যোগান দেয়ার পাশাপাশি বাড়তি আয়ের পথও নিশ্চিত করে। ছোট ছোট কিশোর বয়সের ছেলেরা ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা ভরে হাওর থেকে কলমী শাক সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে পরিবারে আর্থিক সমস্যা সমাধানে ভুমিকা রাখছে।
হাওরে বসতভিটে ছোট থাকার পরও অধিকাংশ পরিবার গরু পালন করে থাকে। বছরের ছয় মাসের জন্য নিজ নিজ সামর্থ্য অনুসারে গবাদি পশুর জন্য খড় সঞ্চয় করে রাখে। কারণ এই সময় কোথাও সবুজ ঘাস মেলে না। যাদের খড় থাকে না তারা কচুরিপানার কচি ডোগা ও পাতা, কুড়া, ভাতের মাড় খাওয়ায়। সুবিধে হচ্ছে, কচুিরপানা প্রচুর থাকায় একদিকে এটি গরুর ঘাসের চাহিদা পূরণ করছে অন্যদিকে বসতভিটাকে আফাল থেকে সুরক্ষা করছে। দিন-রাত উঠোন কিংবা গোয়াল ঘরেই বাঁধা থাকা গবাদি পশুগুলোর এই বিষয়টিকে আপাতঃদৃষ্টিতে করুণ মনে হলেও গবাদিপশুগুলো ঠিকই খাপ খাইয়ে নিয়েছে এরূপ পরিস্থিতির সাথে। পানি কমার সাথে সাথে সবুজ ঘাস মেলে তাদের জন্য। কিন্তু মুসকিল হলো প্রথমদিকে গরুগুলো তা খেতে চায় না। দীর্ঘ ছয় মাসের শুকনো খড় খাওয়ার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে কিছুদিন সময় যে লেগে যায় তাদের!
আঁটিবদ্ধভাবে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীগুলো এক আঁটি থেকে আরেক আঁটিতে যাওয়ার জন্য নৌকা ও বাঁশের সাঁকো ব্যবহার করে থাকেন। বাঁশের সাঁকো ও নৌকা তাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। যাদের সামর্থ্য থাকে তারা নিজেদের ব্যবহারের জন্য নৌকা তৈরি করে রাখে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের নৌকায় করে স্কুলে যায়। তাদের স্কুলগুলোর চারপাশে পানি ও আফাল থাকায় নৌকা ছাড়া স্কুলে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। আবার আফালের মাঝে ছোট ছোট নৌকায় চলাচল করাও খুবই ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। নৌকার অভাবে অনেক শিশুই বছরের ছয়মাস স্কুলে যেতে পারে না; যা তাদের শিক্ষা জীবনে ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বিয়ে ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানেও নৌকার মাধ্যমেই বর ও কনে যাত্রী খুব সহজেই মালামালসহ কম খরচে যাতায়াত করতে পারে। এই কারণে আষাঢ-আশ্বিন মাসে হাওর এলাকায় বেশিরভাগ বিয়ে অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। বিয়ে অনুষ্ঠান হাওরবাসীর বিশেষভাবে যেখানে বিদ্যূৎ নেই ওই এলাকার জনগোষ্ঠীর জন্য বিনোদনের অন্যতম মাধ্যমও বটে। সাধারণত বিয়ে অনুষ্ঠানেই লোকজ সংস্কৃতিগুলোর চর্চা হয়ে থাকে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর (চন্দ্রডিঙ্গা, শিংকাটা, বেতগড়া, পাঁচগাঁ) পাহাড়ি ছড়া দিয়ে আসা বালুর কারণে সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত বিলের মধ্যে কবীর বিল, ফাটা বিল, আগুণঝড়া, ডেঙ্গাহুলি, সেকান্দার, টলা বিলসহ নাম না জানা আরো অনেক বিল ইতোমধ্যে ভরাট হয়ে গেছে। বর্তমানে ধুলিঝড়া বিল ভরাট হতে শুরু করেছে। ভরাট হয়ে যাওয়া বিলগুলোতে বর্তমানে মানুষ বসতি গড়ছে। শীতকালীন শাকসবজি চাষ করছেন। বিলগুলো বর্তমানে মরা বিল বা মৌসুমী বিল হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। পাহাড়ি ছড়া, নদী, বিলগুলো কলমাকান্দার হাওরগুলোতে এসে পতিত হয়েছে বলে হাওরের জনজীবনে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। বিল ও হাওর নির্ভর মৎস্যজীবীরা ইতোমধ্যে পেশা পরিবর্তন করে বহুমাত্রিক পেশা বেছে নিয়েছেন। যেসব পেশায় তারা অভ্যস্ত নয় সেসব পেশায় নিয়োজিত হয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। যার ফলে অনেকে দেশান্তরিত হচ্ছে এবং প্রবেশ করছে অনিশ্চিত জীবনে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।
পাহাড়ি বালু ক্রমেই গ্রাস করছে হাওরগুলোকে। তাই বছরের ছয়টি মাস হাওরনির্ভর জনগোষ্ঠী ও মৎস্যজীবীরা রয়েছেন দারুণ শংকায়। কারণ হাওরের কৃষকরা শুধুমাত্র বোরো ফসল ও শীতকালীন শাকসবজি চাষ করার পর বাকি ছয়টি মাস মাছ ধরে ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এই সময় তাদের আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে মাছ। কিন্তু আন্তঃরাষ্ট্রিক বিভিন্ন সমস্যা বিশেষ করে অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে আজ ব্যাপকভাবে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে হাওরবাসীর জীবনে। পাহাড়ি ঢলের সাথে পাহাড়ি বালু আসাতে হাওরের গভীরতা কমছে, হাওরে জলাবদ্ধতার সময়কাল কমছে, হাওরে পলি জমার পরিবর্তে বালু জমছে। সেই বালু মাটিতে জন্মাচ্ছে না কোন উদ্ভিদ, চাষ হচ্ছে না কোন ফসল।
হাওরের মৎস্যজীবীরা বলছে হাওর এলাকায় একসময় মাছ, অচাষকৃত শাকসবজি, উদ্ভিদ ও ঔষধি গাছের অভাব ছিল না। হাওরে সমুদ্রের মত পানি ছিল। হাওরগুলো অনেক গভীর ছিল। কিন্তু বর্তমানে পাহাড়ি বালুর কারণে হাওরের গভীরতা কমে গেছে, খাল বিলগুলো ভরাট হয়ে গেছে। তাই গভীর পানিতে ও পলি মাটিতে থাকা দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের বাস করার মত উপযুক্ত পরিবেশ নেই। নেই মাছের প্রজনন ও বৃদ্ধির জন্য নিরাপদ বিচরণস্থল। একসময় হাওরে শুধুমাত্র ছোট ছোট নৌকা দিয়ে মানুষ চলাচল করতো। কিন্তু বর্তমানে লঞ্চ, ট্রলার ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা অধিকমাত্রায় ব্যবহার হওয়ায় ইঞ্জিনের পেট্রোল ও ডিজেলের জন্য হাওরের পানি দূষিত হয়ে মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে বলে মৎস্যজীবীদের ধারণা।
এছাড়াও দেশী মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তারা বলছে পানি কমতে শুরু করলে কিছু কিছু জেলেরা পানিতে টারটেল, সার ও লবণ ছিটিয়ে মাছ ধরে। টারটেল, সার ও লবণ ছিটিয়ে দিলে কাদার নীচে লুকিয়ে থাকা মাছ পর্যন্ত পানির উপরে ভেসে আসে। মাছ ধরতে এ পদ্ধতি সহজ হলেও মাটির সাথে লেগে থাকা রেণুুগুলো এতে নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও বোরো মৌসুমে হাওরের কৃষকরা যখন ধান চাষ করে তখন ধানের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে অধিক মাত্রায় কৃষকরা জমিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ঘাস মাড়ার রিফিট ব্যবহার করে থাকে। এসবের বিষাক্ত বিষক্রিয়ায় মাছের রেণুসহ, হাওরের জলজ প্রাণী, শামুক, ঝিনুক, শালুক, শাপলা, কেউরালি, বিভিন্ন লতাগুল্ম প্রভৃতির বীজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেক সংগ্রাম করে যেটুকু শাপলা, শালুক টিকে থাকে তাও আবার মানুষ পরবর্তী সময়ের কথা না ভেবে বর্তমান চাহিদা মিটনোর জন্যে সমুলে উপড়ে নিয়ে আসাতে এগুলোও বিলুপ্তর পথে রয়েছে। ফলে হাওরের পরিবেশ প্রতিবেশ বিপদাপন্ন হয়ে পড়ছে। বিপদাপন্ন হচ্ছে হাওর নির্ভর জনগোষ্ঠীর জীবন জিবন জীবিকা। শিথিল হতে শুরু করছে হাওরের সাথে মানুষের সংযোগ ও বন্ধনের।
হাওরবাসীর অভিমত হাওর না বাঁচলে হাওর জনপদে বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে, যা সামাজিক উন্নয়নে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। তাই উন্নয়ন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে হাওর বাঁচানো উচিত। হাওরকে বাঁচাতে হলে আন্তঃরাষ্ট্রিক বিষয়গুলো বিশেষ করে যেসব বিষয়গুলো বাংলাদেশের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে সেগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। পাহাড় কাটা বন্ধ করার জন্যে বেশি করে পরিবেশবান্ধন বৃক্ষ রোপণ করতে হবে, ভরাট হওয়া পাহাড়ি ছড়া, নদী, নালা, খাল, বিল খনন করতে হবে। প্রত্যেক হাওর, নদী ও বিলের পানির প্রবাহ স্বাভাবিকভাবে রাখার জন্য পরিকল্পিতভাবে বাঁধ দিতে হবে। মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্যে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। মাছের অভয়াশ্রম করার জন্য সরকারি উদ্যোগ ও সহযোগিতা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি হাওরের ওপর মৎস্যজীবীদের অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ দিতে হবে।
দেশীয় মাছের বিলুপ্তির কারণ সম্পর্কে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেবাশিষ বলেন, “মাছের প্রজননের সময় মা মাছ ও ছোট মাছ ধরা, পানি কম থাকা, হাওরের গভীরতা কমে যাওয়া, অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও রিফিট ব্যবহারে মাছের রেণুু নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশি মাছ বিলুপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ।” দেশীয় মাছ সংরক্ষণ ও রক্ষার ক্ষেত্রে তিনি চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে মা ও পোনা মাছ ধরা বন্ধ করা, খনা ও কারেন্ট নিষিদ্ধ এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহার বন্ধ করার আহ্বান জানান।
জীবনধারণের জন্য খাদ্যের সংস্থানে অন্যান্য জীবের উপরই মানুষকে নির্ভর করতেই হয়। তাই যুগ যুগ ধরেই প্রাণবৈচিত্র্যের সাথে মানুষের অস্তিত্ব ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। প্রাণবৈচিত্র্যই প্রকৃতির সেবক। মানুষ এ সেবার সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী জীব। হাওরে রয়েছে প্রাণবৈচিত্র্যের বিশাল ভান্ডার। এই ভান্ডার যত বেশি সমৃদ্ধ হবে তত বেশি নিশ্চিত হবে মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা। তাই হাওরকেন্দ্রিক প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় আসুন আমরা সবাই অবদান রাখি।