ঘোল ওঁদের জীবন জীবিকার উৎস

ঘোল ওঁদের জীবন জীবিকার উৎস

চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু

দুধের সাথে অম্ল জাতীয় পদার্থ যুক্ত করলে দুধের কেজিন প্রোটিন জমাট হয়ে যায়। জমাট হওয়া অংশ ছানা হিসেবে অপসারণ করার পর অবশিষ্ট তরলই ঘোল বা মাঠা। অতীতে মানুষের মধ্যে ঘোল খাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকলেও এখন সহজলভ্য না হওয়ায় ইচ্ছা করলেও অনেকে ঘোল খাওয়ার সূযোগ পান না। তবে প্রতিকূলতা থাকলেও এখনো অনেক মানুষ জীবন জীবিকার তাগিদে ঘোল তৈরি ও বিক্রি করে থাকেন।

ghol pic-1

পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার চর ভাঙ্গুড়া গ্রামের বিরেন ঘোষের ছেলে বিপ্লব ঘোষের বয়স ৩৭ বছর। ২০ বছর যাবত ঘোলের ব্যবসা করছেন। চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ এ তিন মাস ঘোলের ব্যবসা করেন তিনি। ঘি দই ছানার ব্যবসাও করেন তিনি। বিপ্লব ঘোষ বলেন, “ছোট বেলায় পড়া লেখার সুযোগ হয়নি। বাবা ঘি, ঘোল, দই এর ব্যবসা করতেন। পৈত্রিক সূত্রেই এ ব্যবসার হাল ধরি। ছয় বছর বয়সী মেয়ে সিথি ঘোষ স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। বসতভিটা ছাড়া অন্য কোন জমা জমি নেই। ভাঙ্গুড়া এবং এর আশপাশ এলাকায় দৈনিক ঘোল বিক্রি করি। কখনো কখনো উৎসবাদীতে ঘোল বিক্রি করতে চলে যাই দূর দূরান্তে।” তিনি আরও বলেন, “দুধ জ্বাল দিয়ে ঠান্ডা করে ঘুটনী দিয়ে ভালো করে ঘেটে উপর থেকে ক্রিম তুলে নিয়ে তার সাথে লবণ ও চিনি মিশিয়ে পাটের দড়ির সাহায্যে বাঁশের ডগার মাথায় লাগানো ঘুটনী দিয়ে ফের ঘুটে ঘোল তৈরি করি। শরীর ঠান্ডা রাখতে গরমের সময় মানুষ বেশি ঘোল খায়। প্রতি গ্লাস ঘোল দশ টাকায় বিক্রি করি। এটি আমার জীবন জীবিকার উৎস।”

ghol pic-2

এখন থেকে প্রায় তিরিশ বছর পূর্বে ভাঙ্গুড়ার চর ভাঙ্গুড়া গ্রামের জিতেন ঘোষ মারা গেলে সংসার পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে চাপে তার ১১ বছরের ছেলে সুকুমার ঘোষের উপর। পরিবার পরিচালনা করতে কিশোর সুকুমার বেছে নেন ঘি, ঘোল, দই এর পৈত্রিক পেশা। সুকুমারের বয়স এখন ৪৮। সেই থেকে প্রায় ৩৭ বছর যাবত তিনি এ ব্যবসা পরিচালনা করে সংসার পরিচালনা করে আসছেন। ১২ শতাংশ বসতবাড়ি ছাড়া অন্য কোন জায়গা জমি না থাকায় এ পেশাই তার জীবন জীবিকার একমাত্র ভরসা। নিজে পড়ালেখা করার সুযোগ না পেলেও দুই ছেলেকে পড়া লেখা করানোর ইচ্ছা পোষণ করছেন তিনি। বড় ছেলে ভাঙ্গুড়া বিজ্ঞান স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পরছে। সুকুমার বলেন, “স্ত্রী’র সহায়তায় ব্যবসা পরিচালনা করতে পারছি। আমি সকালে দুধ সংগ্রহ করি। ও (স্ত্রী) তিন চার ঘণ্টা দুধ জ্বাল দেয়। এরপর লবণ চিনি মিশিয়ে ঘুটনী দিয়ে ঘুটে ঘোল তৈরি করি। প্রতিদিন ৩০ লিটার বা এর কিছু কম বেশি দুধ কিনি। ও দই, ঘোল তৈরি করে দেয় আমি সেগুলো বাজারে বিক্রি করি। বেশি দামে খড়ি ঘুটেসহ অন্যান্য জ্বালানি কিনতে হয়। প্রতিদিন তিন চারশো টাকা লাভ থাকে। সব মিলিয়ে কোন রকমে চলে যাচ্ছে দিন।”

ghol pic-3

সুকুমারের সহোদর ভাই নবচন্দ্র ঘোষ। নব ঘোষ বলেই সবাই চেনে তাকে। নব ঘোষ বলেন, “ছোট বেলায় বাবা মারা গেলে বড় ভাই সুকুমারের উপর পরিবারের দায়িত্ব পরে। আমার জ্ঞান বুদ্ধি হবার পর ভাইয়ের সাথে এ ব্যবসায় সম্পৃক্ত হই। দুই ছেলে আমার। বড়টা স্থানীয় একটা স্কুলে পড়া লেখা করছে। অপরটি ছোট। ও এখনো স্কুলে যায় না। সকাল থেকে সন্ধ্যা খাটা খাটনী করে প্রতিদিন চার পাঁচশো টাকা আয় করি। এ দিয়ে মোটা মুটি চলে যাচ্ছে দিন।”

ghol pic-4

বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষের উপাদেয় পানীয় ঘোল। গরমে স্বস্তি পেতে মানুষ ঘোলের শরবত পান করে। ভিটামিন এ, বি, ও সি সমৃদ্ধ ঘোল শরীরের পুষ্টির জন্য উপকারী। বদ হজম দূর করতে, হজম ক্ষমতা বাড়াতে, মেদ কমাতে পুষ্টিতে ভরপুর ঘোল রাখে বিশেষ ভূমিকা। ঘোল আমাদের শরীর ঠান্ডা রাখে। ক্লান্তির ভাব দূর করে। রক্তচাপ, ওজন ও কোলেষ্টেরলের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করে। এটি হার্টের জন্যও বেশ উপকারী। শরীরের বৃদ্ধি ও ত্বকের ক্লিনজারে ঘোল সহায়তা করে। ঘোলের মধ্যে থাকা জিঙ্ক ও আয়রন মানব দেহের জন্য প্রয়োজনীয়। গ্রাম এলাকায় অতীতে বাঁশের বাইকের দুই প্রান্তে পাটের শিকেয় মাটির পাতিলে করে ঘোষেরা ঘোল বিক্রি করলে এখন সে দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে না।

happy wheels 2

Comments