আমাদেরও অধিকার আছে
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
বাংলাদেশে নারী ও পুরুষের মধ্যে আরও একটি লিঙ্গভূক্ত জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজরা জনগোষ্ঠী নামে পরিচিত। তৃৃতীয় লিঙ্গের এই জনগোষ্ঠী পরিবার, সমাজ ও রাাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ও অবহেলিত। সমাজের মানুষ এদেরকে ঘৃণার চোখে দেখে। সকলের নিকট তারা হাসির পাত্র। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের কোন উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাদের জন্য কোন বরাদ্দ রাখা হয়না। ভিক্ষা করে বা চাঁদা তুলে তাদের জীবন কাটে, তাদের নেই কোন স্থায়ী আবাস। আজ এখানে তো কাল অন্যখানে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের কোন অনুষ্ঠানাদিতে তাদেরকে কখনো আমন্ত্রণ করা হয়না। তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীরাও যে এদেশের নাগরিক, তাদের মধ্যেও যে রয়েছে দেশাত্মবোধ, দেশপ্রেম এবং দেশের উন্নয়নে তাদেরও যে নারী-পুরুষ জনগোষ্ঠীর ন্যায় সমান দায়িত্ব রয়েছে, তারাও যে সমাজ ও দেশের উন্নয়নের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে তা কখনো ভাবা হয় না। অথচ রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীদেরকে নিয়োগ দেয়া হলে তারা তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পেত।
তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যা জানা এবং তাদের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সেবা ও সুযোগ-সুবিধাসমূহে তাদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণে সাম্প্রতিক সময়ে নেত্রকোনা সদর উপজেলার জেলা মইনপুর গ্রামের “ধলাই পাড়ের আমরা ক’জন কিশোরী সংগঠন’ এর উদ্যোগে তৃতীয় লিঙ্গের ১২জন সদস্য নিয়ে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ নারী প্রগতী সংঘের “আমি এক এবং অনেক” প্রকল্পের সদস্যরা, ধলাই পাড়ের কিশোরী সংগঠন ও বারসিক।
শুরুতে সভার উদ্দেশ্য তুলে ধরেন কিশোরী সংগঠনের সভা প্রধান মামনি আক্তার। পরবর্তীতে অংশগ্রহণকারী তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধিরা প্রত্যেকে নিজেদের জীবন ও জীবীকায়নের বর্তমান অবস্থা ও অবস্থান সকলের সাথে সহভাগিতা করেন। তৃতীয় লিঙ্গের দলনেতা লাকি তাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলেন, “আমাদের নিদির্ষ্ট কোন বাসাবাড়ি নাই, কোন স্থায়ী ঠিকানাও নাই, বোঝার বয়স হওয়ার পর পরিবার থেকে বিছিন্নভাবে বড় হইছি, আমাদের জন্য পরিবারের যেন কোন দায়িত্ব নাই, আমরা এ সমাজের কোন মানুষ না, আমরা সমাজের একটি অভিশপ্ত প্রাণী।”
তৃতীয় লিঙ্গের আরেক অংশগ্রহণকারী হুমায়ুন বলেন, “ধন্যবাদ জানাই বারসিক ও কিশোরীদের যারা আমাদেরকে এখানে ডেকেছে, আমাদের দুঃখ কষ্টগুলো শুনতে চাইছে। এই প্রথম কিছু ভালো মানুষের সাথে আমরা এক সাথে বসলাম, খুব ভালো লাগছে।” তিনি আরও বলেন,“আমরা সরকারি-বেসরকারি কোন ধরনের সহায়তা কোন দিন পাই নাই, কোথা থেকে এগুলো দেয় আমাদের তা জানা নাই।”
ফুল নামের তৃতীয় লিঙ্গের অপর সদস্য বলেন, “১২ বছর থেকে আমি আমার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, জন্মের পর থেকে মা-বারা আমাকে স্বীকার করতে চায় না, একটু বড় হতেই বাড়ি থেকে বের হয়েছি। আমি বাড়ি থাকলে আমার ভাই-বোনদের সামাজিক মর্যাদা ঠিক থাকে না। এখন মাঝে মাঝে মাকে দেখতে বাড়ি যাই রাতের অন্ধকারে আবার রাতের অন্ধকারেই চলে আসি। এ জীবন আর ভালো লাগেনা, আমাদের একটি নির্দিষ্ট ঠিকানা ও একটি সম্মানজনক কাজের ব্যবস্থা যদি সরকার করে দিত যা’ করলে সমাজে মানুষগুলো আমাদের ঘৃণা করবে না। আমরা সমাজে নারী-পুরুষদের মত মর্যাদা পেতাম।”
ধলাই পাড়ে কিশোরী সংগঠনের সভা প্রধান মামনি আক্তার বলেন,“আপনাদের সমস্যাগুলো শুনলাম, সমস্যাগুলো নিয়ে বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে আমরা যোগাযোগ করব। আপনারা যে কথাগুলো আজ বলেছেন, এগুলো আপনাদের প্রাপ্য অধিকার। অধিকার আদায়ে আপনাদেরকে একত্রিত ভাবে কাজ করতে হবে, আমরা আজ থেকে সব সময় আপনাদের পাশে থাকব।”
লাইলা (তৃতীয় লিঙ্গ) বলেন, “আজ এখানে এসে সবার আলোচনা শুনে প্রথমবার মনে হচ্ছে আমরাও মানুষ, এই প্রথম এধরনের কোন আয়োজনে আসলাম। যারা এ আয়োজন করেছেন তাদের সাবাইকে ধন্যবাদ জানাই। তবে এ আলোচনা যেন এখানে শেষ না হয়, আমরা আশা করব আমাদের সাথে আপনারা সব সময় থাকবেন।”
‘আমি এক ও অনেক’ প্রকল্পের সদস্য উর্মি আক্তার বলেন, “আজ থেকে আপনাদের (তৃতীয় লিঙ্গের লোক) সম্পর্কে আমাদের ধারণার পরিবর্তন হয়েছে, আপনাদের সকল ভালো কাজে আমরা থাকব। আমাদের প্রকল্পের মাধ্যমে আপনাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করব।”
বারসিক’র প্রতিনিধি তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্টীর অধিকার সুনিশ্চিতকরণে এবং সরকারি-বেসরকারি সেবাসমূহে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণে সকল প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে তাদের যোগসুত্র স্থাপনে বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করেন। স্থানীয় সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন সেবাসমূহ প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীদের নিয়ে নেত্রকোনা সদর ইউনিয়নের স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের সাথে একটি মতবিনিময় সভা আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্তের কথা বলেন।
আলোচনা শেষে বারসিকের পক্ষে থেকে আয়োজক কিশোরী সংগঠন ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সকল তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে ধন্যবাদ জানান খাদিজা আক্তার লিটা। অনুষ্ঠান শেষে বর্তমান প্রজন্মের যারা এক সময় এ সমাজের কর্ণধার হবে, তারা যেন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদেরকে সমাজ বিছিন্ন কোন প্রাণী হিসেবে মনে না করে তাদেরকে মানুষ হিসেবে মানার শপথ গ্রহণ করে।
আসুন আমরা সকলে কিশোরী সংগঠনটির ন্যায় নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর প্রতি সাধারণ মানুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনয়নে প্রচারণার উদ্যোগ গ্রহণ করি। প্রথমে নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাই এবং পরে অন্যদেরকে উদ্বুদ্ধ করি। তবেই হয়তো একদিন তৃতীয় লিঙ্গের জীবনমান স্থায়িত্বশীল হবে।
………