প্রাকৃতিক রক্ষা কবচ ও সৌন্দর্যের আধার বট গাছ
মানিকগঞ্জ থেকে নজরুল ইসলাম
বট তথা বট গাছ ইংরেজি (ইন্ডিয়ান বেনিয়ান) বৈজ্ঞানিক নাম ফাইকাস বা (ডুমুর জাতীয়) গোত্রের ইউরোস্টিগ্ম উপগোত্রের সদস্য। এর আদি নিবাস হলো বঙ্গভূমি। এটি অপেক্ষাকৃত অন্য বৃক্ষের চেয়ে বৃহৎ আকারের উদ্ভিদ জাতীয় বৃক্ষ। এই গাছ বিশাল জায়গাজুড়ে এর শাখা প্রশাখা বিস্তার করে। যারা স্তম্ভমুলের উপর ভর করে থাকে।
স্তম্ভমূল প্রথমে সরু সরু ঝুরি বা জট হিসেবে বাতাসে ঝুলতে থাকে তারপর প্রকৃতিগতভাবেই মাটিতে স্পর্শ করে এবং মাটি ভেদ করে প্রোথিত হয় এবং বিটপে পরিণত হয়। বট পাতা মসৃণ আকারে বড়, ডিম্বাকৃতির ও উজ্জ¦ল সবুজ বর্ণের। স্থান কাল পাত্র ভেদে পাতার ভিন্নতা ও বৈশিষ্ট্য দেখে বট গাছ শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। বট গাছের সাথে সচরাচর আর একটি গাছ যৌথভাবে বেড়ে ওঠে সেটি হলো পাকর গাছ। এই গাছের পাতা ডিম্বাকৃতির হলেও সামনে বেশ সরু হয় এবং উজ্জ্বল সবুজ বর্ণের হয়। বট গাছ তার জটা দিয়ে নিজেই তার জায়গা করে নেয় এবং একসময় মহীরুহতে পরিণত হয়। বসন্ত ও শরৎকালে বটগাছে নতুন পাতা গজানোর সময়। এ সময় কচি পাতার রং উজ্জ্বল সবুজ থাকে। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত হলো ফল পাকার সময়।এটি চিরহরিৎ সাইকাস বহুবর্ষজীবি গাছ।
বট ও বটজাতীয় গাছের বংশবৃদ্ধির পদ্ধতি ও কৌশল অভিন্ন। মঞ্জুরির গর্ভে ফুলগুলো লুকানো থাকে। ফুলগুলো খুবই ছোট এবং ফলের মত গোল। একলিঙ্গিক এই ফুলগুলো পরাগায়ণের জন্য বিশেষ জাতের পতঙ্গের উপর নির্ভশীল। পাখিরা ফল খেয়ে বীজ ছড়িয়ে দেয়। পাখিবাহিত এই বীজ দালানের কার্নিশ, বিভিন্ন গাছের মগডালে, চালের উপর, পুরানো দালানের ফাটলসহ বিভিন্ন স্থানে বট ও পাকর গাছ এক সাথে বা আলাদা আলাদাভাবে অঙ্কুরিত হয়ে থাকে। এ কারণে উপগাছা হিসেবে বা পরগাছা হিসেবে এই গাছের খ্যাতি রয়েছে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে একটি বটগাছ ৫-৬ শত বছর বাঁচতে পারে। কথিত আছে, বট হলো মা আর পাকর হলো বাবা অর্থাৎ বট ও পাকর গাছ হলো স্বামী-স্ত্রী। কোন স্থানে এই দুটি গাছের যুগল মিলন হলে হাজার বাছর বা তারও বেশি বেঁচে থাকার উদাহরণ আছে।
মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলায় বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের কাউটিয়া হলো আমার জন্মভুমি গ্রাম। এই গ্রামে জেলার সবচেয়ে বৃহৎ বট বৃক্ষের মধ্যে অন্যতম এই বৃক্ষে শোভা পেয়েছে পাকর গাছের। বট-পাকরের এই যুগল মিলনে দীর্ঘজীবী হয়েছে শতবর্ষী এই বটবৃক্ষ। বটগাছের পাশেই আছে ফকির বাড়ি। ফকির বাড়ির ইতিহাসও অনেক বড়। আখের ফকির, ইন্তাজ ফকির ও ইয়াজুদ্দিন ফকির। তারা বাউল মতবাদ ও আধাত্মিক সাধনার দিক্ষাগুরু ছিলেন।
বটতলা প্রতিবেশী মো. আতোয়ার কাজী (গুসাই)। তাঁর পিতা মৃত লোকমান কাজী (সুফি সাধক)। আতোয়ার গুসাই বলেন, ‘ধারণা করা হয় বট ও পাকর দুটি গাছ এর জন্ম একই সময়। এটিও ধারণা করা হয় যে, প্রতিবেশী পুরান গ্রামের বুড়িমা নামে খ্যাত তার ছনের ঘরে পরগাছা হয়ে দুটি চারা ছিল। তার বাড়িতে এই গাছ রোপণের জায়গা ছিলো না। চারা দুটি তিনি কোথায় ফেলবেন এ চিন্তা করেই অবশেষে তিনি কাউটিয়ার ফকির বাড়ির সামনে ফেলে যান। এভাবে এখানে চারা দুটির জন্ম হয়।’ বটতলার প্রতিবেশী খাজা মো. ইফনুস আলী, নিজাম উদ্দিন গাছী, শওকত আলী পীর সাহেব, মো. মফজেল ও মান্নু মিয়া, মহিদুর রহমান মহিদ, মো. সুলতান আলী প্রায় একই ধরনের কথা বলেন। আবার অনেকের ধারণা এটি প্রাকৃতিকভাবে হয়েছে।
বৃক্ষ দুটির বয়স আনুমানিক প্রায় ৩০০ বছর। বিশাল জায়গা দখল করা গাছটি খাস (সরকারি) জায়গার মধ্যে তার স্তম্ভমূল দাঁড়িয়ে আছে। মো. ইফনুস আলী বলেন, ‘এই গাছের আশেপাশে অনেক জায়গা ছিল সেটি মানুষ দখল করেছে। ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা বন্ধ হয়েছে। সাংস্কৃতিক চর্চা, শরীর চর্চা আগের মত নেই। নতুন রাস্তা হয়েছে কিন্তু বটতলার সৌন্দর্য বাড়েনি বরং শ্রী হারিয়েছে। তবে রাস্তা সমান করে মাটি দিয়ে ভরাট করলে হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়া সম্ভব।’ এই বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় ইউপি সদস্য কাজী মাহেলা বলেন, ‘বটগাছ আমাদের গ্রামের সবচেয়ে বড় ঐহিত্য। এটি সংরক্ষণ করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। রাস্তার কাজ চলছে বটগাছের চারপাশ সৌন্দর্য্যরে জন্য ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে এবং অচিরেই নদী শাসনের কাজ আসলে তখন এটি ভরাট করা হবে।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক’র আঞ্চলিক সমন্বয়কারি বিমল রায় বলেন, ‘বটগাছ আকারে যেমন বড় কাজেও তেমনি বড় বট গাছের তুলনা কেবল বটগাছই। আমরা দীর্ঘদিন ধরে প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের অংশ হিসেবে জেলার সিংগাইর, হরিরামপুর, সদর ও ঘিওর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, হাট বাজার ও রাস্থার ধারে উদ্যমী তরুণ, যুব ও সামাজিক সংগঠনের সাথে যৌথভাবে বট বৃক্ষ লাগিয়ে আসছি। এটি চলমান থাকবে এবং বটগাছের উপর যেন কোন প্রকার সহিংসতা না হয় এ জন্য আমরা সচেনতামূলক কাজ করে যাব।’
মো: ইফনুস আলী ও মো. শহিদুল ইসলাম ঠান্ডু বলেন, ‘এই গাছকে ঘিরে রয়েছে শত বছরের ঐতিহ্য। গরমের দিনে এই ছায়া বৃক্ষটি আমাদের অনেক উপকার করে। এখানে আমরা মেলা করেছি, লোক গানের আসর জমেছে, আবার মিলাদ মাহফিলও করেছি।’ কোমর আলী পীর সাহেব বলেন, ‘এই গাছের আঠা পা ফাটা সারায়, বটের ছাল দেহের মেদ কমায়। হাড় মচকে গেলে এর ছাল বেটে গরম করে মালিশ করলে আরাম পাওয়া যায়। এছাড়াও বট গাছের ফল কাক, শালিক ও বাদুরের প্রিয় খাদ্য এবং শকুনও এ জাতীয় পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বটের কষ থেকে নিম্নমানের রাবার তৈরি করা যায়। বট পাতা কুষ্ঠ রোগে অনেক উপকারি।’
প্রাকৃতিক রক্ষা কবচ, প্রাকৃতিক বর্ম, অক্সিজেনের বিশাল আধার আমাদের এই বট গাছ সকল মানুষের সকল প্রাণের এবং প্রাণবৈচিত্র্যের বিরাট অংশীদার।