নারীদের নিজস্ব অধিকার আছে
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
“সবাই মিলে ভাবো, নতুন কিছু কর, নারী-পুরুষ সমতার বিশ্ব গড়ো” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে গত ৮ মার্চ ২০১৯ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নেত্রকোনা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। তিনদিন ব্যাপি আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন উপলক্ষে ৭ মার্চ ২০১৯ সকাল ১০ টায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের অংশগ্রহণে নেত্রকোনা শহরে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। ৮মার্চ সকাল ১০ টায় আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বিভিন্ন শ্লোগান, ব্যানার, ফেষ্টুন সহকারে একটি র্যালি পুরো শহর ঘুরে পুনরায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়। র্যালিতে সমকাজে সমমজুরি, কর্মক্ষেত্রে নারীর সুযোগ ও সমমর্যাদা শ্লোগানে গোটা শহর মুখরিত হয়ে উঠে।
দিবসটি উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ও জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর আয়োজিত অনুষ্ঠানে অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অংশগ্রহণ করে স্বাবলম্বীর উন্নয়ন সমিতি, নারী প্রগতি সংস্থা, সেরা, নারী উদ্যোগ ও বারসিক। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ মেলায় ১৬টি স্টলে নারী অধিকার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বই, লিফলেটসহ নারীদের উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য প্রদর্শন করে। অনুষ্ঠান উপলক্ষে ৮ মার্চ ২০১৯ মনোনীত নারী সাংসদ মাননীয়া হাবিবা রহমান খান শেফালি এর নেতৃত্বে এক বর্ণাঢ্য র্যালির আয়েজন করা হয়, যেখানে জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিসহ বিভিন্ন শ্রেণী, পেশার ও বয়সের লোক অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও দিবসটি উপলক্ষে দু’দিনব্যাপী বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সভা, সফল উদ্যোগী নারীর আত্মকথন, শিক্ষার্থীদের জন্য বির্তক প্রতিযোগিতা ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মাননীয় জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম এর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংরক্ষিত আসনের সাংসদ মাননীয়া হাবিবা রহমান খান শেফালি, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পুলিশ সুপার জয়দেব চৌধুরী ও সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান তুহিন রহমান। আলোচনা অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ফেরদৌসি বেগম। অন্যান্য আলোচকদের মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন এনজিও কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, মানবাধিকার কর্মী, জনসংগঠনের প্রতিনিধিগণ।
প্রধান অতিথি মাননীয় সংসদ সদস্য হাবিবা রহমান খান শেফালি বলেন, ‘নারীদের নিজস্ব অধিকার আছে। আমরা প্রায়ই বলে থাকি আমাদের অধিকার দিতে হবে। কিন্তু অধিকার এমনি এমনি পাওয়া যায় না, নিজের অধিকার নিজেরই আদায় করে নিতে হবে। নারীরা ইচ্ছা করলে অনেক কিছু করতে পারে। আমরা নারীরা সবই পারি, কিন্তু অলসভাবে বসে থাকলে নারী সমাজ জাগবে না। প্রতিটি ঘর থেকে ইচ্ছা করলে আমরা নারী জাগরণ আরম্ভ করতে পারি। অফিস আদালতে কোথাও নারীরা পিছিয়ে নেই। আজকের ৮ই মার্চ আর্ন্তজাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, “সবাই মিলে ভাবো, নতুন কিছু কর, নারী-পুরুষ সমতার বিশ^ গড়ো”। এই কথাটি সকলকে মনে রেখে নিজেদের পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।’
অনুষ্ঠানের সভাপতি মাননীয় জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম বলেন, ‘নারীদের উন্নয়নে আমাদের সরকার অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, এর মধ্যে নারীর ক্ষতায়ন উল্লেখযোগ্য। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ও সমাজ সেবা অধিদপ্তরসহ আরো অনেক বিভাগের মাধ্যমে সরকার নারীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। নারী ক্ষমতায়নে জন্য জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত আসন রাখা হয়েছে। নারী ক্ষমতায়নের জন্য জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভায় নারীদের জন্য অনেক সেবা ও সুযোগ রাখা হয়েছে। নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই। তারা পুরুষদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। স্কুল কলেজে পড়াশোনার ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে আছে।’
আলোচনা অনুষ্ঠানের শেষে নারীদের অংশগ্রহণে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, নারী নির্যাতন ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে নারীদের অংশগ্রহণে সচেতনতামূলক নাটক এবং সফল নারীদের কথোপকথন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। শিশুরা তাদের ইচ্ছামত ছবি আঁকা ও নাটিকার মধ্যমে নারী নির্যাতন ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচারণা চালায়। বিভিন্ন শ্রেণী, বয়স ও পেশার (নারী-পুরুষ, শিশু, প্রবীণ, নবীন, শিক্ষার্থী, কৃষক, কামার, কুমার, জেলে) পাঁচ শতাধিক লোক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। নারী দিবসে কাইলাটি ইউনিয়নের বড় কাইলাটি গ্রামের শিকড় কিশোরী সংগঠন ও ফচিকা গ্রামের অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠন নিজেদের হাতে তৈরি নানা ধরণের হস্তশিল্প পণ্য মেলার স্টলে বিক্রির জন্য প্রদর্শন করে। জেলা প্রশাসন মঈনউল ইসলাম ও জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মেলার স্টলগুলো ঘুরে দেখেন। নারী দিবস উপলক্ষে নেত্রকোনা সদর উপজেলার দু’জন মাকে ‘জয়িতা’ সম্মাননা প্রদান করা হয়।
ফচিকা গ্রামে অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠনের সদস্য লাবনী আক্তার বলেন, ‘নারী দিবস কি তাই আমরা আগে জানতাম না। অনেক মেয়ের বাল্য বিবাহ হয়, আমাদের এলাকার বউরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। আমরা কখনো এ ধরণের নাটক করা সুযোগ পাই না, আজ নাটকে অভিনয় করে আমি আনন্দ পাইলাম। আমরা স্টলে নিজেদের হাতে তৈরী জিনিস প্রদর্শন করতে পেরে খুব আনন্দ লাগছে।’
আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রতিবছরই উদ্যাপিত হয় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সংগঠন পর্যায়ে। ই্উনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে গ্রামের সাধারণ জনগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনসংগঠনগুলো অংশগ্রহণ করতে পারলেও জেলা পর্যায়ের মত বড় ধরণের আয়োজনগুলোতে এসব জনগোষ্ঠী ও জনসংগঠনগুলোর অংশগ্রহণ হয়ে ওঠেনা। জেলা পর্যায়ে এরা শুধুমাত্র র্যালিতে এবং অনুষ্ঠানের দর্শক/শ্রোতা হিসেবেই অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, অনুষ্ঠানে বক্তা বা পারফরমার হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ তাদের হয়না। ২০১৯ সালের ৮ ও ৯ মার্চে নেত্রকোনা জেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত আর্ন্তজাতিক নারী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রত্যন্ত গ্রামের নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী ও কিশোরীরা মানববন্ধন, র্যালি, আলোচনা সভা, চিত্রাঙ্কন ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা, স্টল প্রদর্শনী এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে সমাজে নারীদের শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়ণ ও অধিকারের কথা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামের নারী ও কিশোরীদের জেলা পর্যায়ের মত বড় ধরণের আয়োজনে অংশগ্রহণ নারীদের ক্ষমতায়নের পথে অগ্রসরতার কথারই জানান দেয়।
……….