রাজশাহীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রথম বীজ লাইব্রেরি
বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে শহিদুল ইসলাম ও অমৃত কুমার সরকার
পটভূমি
বারসিক দীর্ঘদিন থেকে কর্মএলাকায় প্রত্যক্ষভাবে কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার কাজে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করে আসছে। যেমন, এলাকা উপযোগী জাতসুরক্ষা, গবেষণা এবং কৃষিতে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন দিকগুলো। এই কাজের অংশ হিসেবে বারসিক জননেতৃত্বে বরেন্দ্র অঞ্চলে বীজ, শস্য, উদ্ভিদবৈচিত্র্য মেলা, কৃষক নেতৃত্বে জাত গবেষণা, কৃষি এবং কৃষি শ্রমিকের প্রতি সম্মানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি করে থাকে। একই সাথে বারসিক নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই কাজের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাসহ কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার দিকগুলো সচেতনতামূলক বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের উন্নয়নে কৃষি অন্যতম একটি মাধ্যম। কিন্তু বাংলাদেশর পরিসংখ্যান হিসেব মতে, এই দেশেরে কৃষিতে তরুণসহ নতুন প্রজন্মের আগ্রহ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। বলা হয়, ১৯৯১ সালে ২৫-২৯ বছরের তরুণদের অংশগ্রহণ ছিলো ৫২.১ ভাগ, কিন্তু ২০১১ সালে এসে তা কমে দাড়িয়েছে ৩৮.৯ ভাগে। কর্মএলাকায় প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ও তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, এই চিত্রটি বেশির ভাগ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিতদের মধ্যে বেশি। এভাবে কৃষিতে তরুণদের অংশগ্রহণ কমতে থাকলে তাদের মধ্যে একসময় বাস্তবধর্মী কৃষিজ্ঞান, কৃষিকেন্দ্রিক লোকায়ত চর্চার দিকগুলো কমতে থাকবে, যা মাঠ পর্যবেক্ষণে এবং দীর্ঘ সময় কাজের মধ্যে দিয়ে জানা গেছে। আবার এভাবে চলতে থাকলে নিজের এলাকা উপযোগী বৈচিত্র্যময় জাত সুরক্ষাসহ কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্যের নানা দিকগুলো আরো সংকটের মুখে পড়বে। কারণ ভবিষ্যতে এসব দায়িত্ব নেয়ার বা বোঝার মানুষ কমে যাবে সমাজে। একইসাথে কৃষি শ্রমিক, কৃষি ও কৃষিতে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার বাস্তব বিষয়গুলো কমে যাবার সম্ভাবনা আছে। উক্ত বিষযগুলোকে কেন্দ্র করে বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নবীণ ও তরুণদের মধ্যে কৃষিজ্ঞান চর্চা, বীজ সুরক্ষা, উদ্ভিদবৈচিত্র্য পরিচিতকরণ, মৌসমভিত্তিক কৃষি জ্ঞান, লোকাযত চর্চা, দেশী বীজ সুরক্ষাসহ ইত্যাদি বিষয়গুলো সচেতনতা ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে ‘বীজ লাইব্রেরি’ গঠন করা করার প্রস্তাব করা হয়।
বীজ লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার সুনিদিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
১। নবীণ ও তরুণ শিক্ষিত প্রজন্ম নিজের এলাকার কৃষিজ্ঞান এবং কৃষি চর্চার দিকগুলো জানতে পারবে। নিজেরা এই উন্নয়নের সাথে সংযুক্ত হতে পারবে।
২। নিজের এলাকার শস্যফসলসহ বিভিন্ন জাতগুলো সম্পর্কে জানবে এবং চিনবে। এগুলো সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারবে।
৩। নিজেরা বিভিন্ন বীজ আদান প্রদান যেমন-হোমস্টেড গার্ডেন, ফুলের বাগান, স্কুলে বাগান করাসহ ইত্যাদি বিষয়গুলোর সাথে প্রত্যক্ষ পরিচিত ঘটবে। বীজ বিনিময় চর্চা গড়ে উঠবে।
বীজ লাইব্রেরীর উপযোগীতা ও চাহিদা বিবেচনায় বিভিন্ন পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর মতামত
দীর্ঘ ছয় মাস (জানুযারি-জুন, ২০১৮) থেকে এ বিষয়ে জানার জন্যে বা স্কুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বীজ লাইব্রেরি গঠনের উপযোগীতা, পরিচালনা ও নিয়ম কানুনসহ ইত্যাদি দিকগুলোর জন্যে রাজশাহী জেলার তানোর ও পাবা উপজেলার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ ওই উপজেলার প্রশাসন, কৃষি কর্মকর্তা, উন্নয়ন কর্মী, গবেষক, কৃষক, অভিভাবক এর সাথে বিস্তারিত প্রত্যক্ষ আলোচনা দিকগুলোর পরামর্শ চাওয়া হয়। সকলের পক্ষ থেকে বীজ লাইব্রেরি একটি অত্যন্ত উপযোগী বিষয় মনে করেছেন। একই সাথে এটি পরিচালনাসহ সার্বিক দিকগুলোর পরামর্শ দিয়েছেন। জনগোষ্ঠীর সেই পরামর্শগুলো নীচে তুলে ধরা হলো:
১. প্রাথমিকভাবে যে স্কুলে / শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কৃষি শিক্ষা পড়ানো হয় এবং শিক্ষক আছেন সেই স্কুলেই তাদের আগ্রহ অনুযায়ী বীজ লাইব্রেরি গঠন করা হবে।
২. বীজ লাইব্রেরির ঐ স্কুলের কৃষি শিক্ষক বা প্রধান শিক্ষক কর্তৃক মনোনীত শিক্ষক পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন।
৩. রেস্টরুম/কমন রুম/ অফিসের দেয়ালে (যেককোন একটি দেয়াল যেখানে সবাই দেখতে পারবে, এমন জায়গায়) প্লাসটিক/স্বচ্ছ ফয়েল পেপার/পেট্রি ডিসে বীজ টাংগানো থাকবে, যেখানে নেম ট্যাগ, মৌসুমসহ উল্লেখ থাকবে।
৪. মৌসুমভিত্তিক বীজ সংগ্রহ উৎসব করা হবে। অল্প পরিমাণে বা কম করে বীজ এনে বোয়ামের ভেতর রাখা হবে, সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা চাহিদা অনুযায়ী বীজ বিনিময় করতে পারবেন। একজন শিক্ষার্থী তার বাবা মাকেও এই বীজ দিয়ে সহায়তা করবেন। তবে এখানে উল্লেখ যে অনেক বেশি বীজ এখানে সংগ্রহ করা হবে না। নমুনা থাকবে। বীজ লাইব্রেরিতে তথ্য থাকবে যে ঐ বীজ কার কাছে বা কোথায় পাওয়া যাবে।
৫. সম্ভব হলে, একটি বা দুটি রেজিষ্টার সংরক্ষণ করা হবে। যেখানে বীজ বিনিময় এবং বীজ সংরক্ষণের দিকগুলো নথিভুক্ত হবে। এটি স্কুলের পরিচালনার দায়িত্বে যে শিক্ষক থাকবেন তিনি করবেন বা কারো মাধ্যমে/ আগ্রহী ছাত্রদের মাধ্যমে করিয়ে নিবেন।
৬. প্রতি তিনমাস বা মৌসুমভিত্তিক ছাত্রদের নিয়ে বীজ লাইব্রেরি, বীজ বা বীজ ব্যাংক কেন্দ্রিক ক্যাম্পেইন/ কর্মসূচি করা যেতে পারে।
৭. প্রধান পরিচালক (কৃষি শিক্ষক যদি থাকে) বীজ লাইব্রেরি আরো কার্যকর পরিচালনার জন্যে শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব বিভাজন বা একটি কমিটি করবেন। এই কমিটিতে প্রধান পরিচালকসহ বারসিক’র একজন কর্মকর্তা থাকবেন।
৮. কোনভাবে বীজ কেন্দ্রিক বা বীজবিনিময়ে আর্থিক লেনদেন করা যাবে না । শুধু আগ্রহীদের মধ্যে বীজ বিনিময় করা হবে।
৯. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষকগণ এখানে বীজ বিনিময় করতে পারবেন।
১০. বীজ লাইব্রেরি এর মাধ্যমে বা উদ্যোগে এবং বারসিক’র সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আশেপাশের কৃষকদের সফল উদ্যোগগুলো প্রত্যক্ষভাবে জানতে প্রত্যক্ষ পাঠশালায় (অভিজ্ঞতা বিনিময়) অংশগ্রহণ করবেন।
রাজশাহীতে প্রথম প্রতিষ্ঠা হলো বীজ লাইব্রেরি
স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা অনুযায়ী বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রথম প্রতিষ্ঠা হলো বীজ লাইব্রেরি। গত শনিবার রাজশাহীর তানোর উপজেলার তালন্দ আনন্দ মোহন উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে এই বীজ লাইব্রেরি প্রাথমিকভাবে যাত্রা শুরু করলো। গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক, বরেন্দ্র কৃষক বীজ ব্যাংক ও তালন্দ আনন্দ মোহন উচ্চ বিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে বীজ লাইব্রেরির শুভ উদ্বোধন করেন তানোর উপজেলার নির্বাহী অফিসার চৌধুরী মো. গোলাম রাব্বী। উপস্থিত ছিলেন বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক’র সভাপতি ও জাতীয় পরিবেশ পদকপ্রাপ্ত কৃষক ইউসুফ আলী মোল্লা, জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত আদর্শ কৃষক নুর মোহাম্মদ, তানোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা এমদাদুল ইসলাম, তালন্দ আনন্দ মোহন উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষব বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক, প্রধান শিক্ষক আলতাফ হোসেন, বারসিক বরেন্দ্র অঞ্চলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ, এলাকার কৃষকসহ স্কুলটির তিন শতাধিক শিক্ষার্থী।
বীজ লাইব্রেরি উদ্বোধন শেষে ‘বীজ ও আমাদের লোকায়ত কৃষি বিজ্ঞান’ সম্পর্কিত সচেতনতামূলক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আলোচনা অনুষ্ঠানে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি ও বীজ নিয়ে কথা বলেন ইউসুফ আলী মোল্লা। তিনি বলেন, ‘আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চলটি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য, এখানে খরা বেশি, পানির সমস্যা। আমাদের কৃষি এবং শস্য ফসলের কিছু উপযোগী ফসল আছে, সেগুলো নতুনদের চিনতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘নতুনরাই আগামীতে আমাদের কৃষি সুরক্ষা করবেন, তাই নতুনদের আমাদের নিজস্ব কৃষিজ্ঞান এবং শস্য ফসলের জাত সম্পর্কে জানতে হবে।’ প্রধান অতিথি ও উদ্বোধক তানোর উপজেলার নির্বাহী অফিসার চৌধুরী মো. গোলাম রাব্বী বলেন, ‘বাংলাদেশে এই প্রথম বীজ লাইব্রেরি তানোরে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। এটা আমাদের জন্যে একটি গর্বের বিষয়। কৃষি সম্পর্কিত জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে এই বীজ লাইব্রেরি অনেক বেশি ভূমিকা পালন করবে। ধীরে ধীরে আমরা তানোরের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এই বীজ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করবো।’ কৃষি কর্মকর্তা এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষার্থী, নতুনদের মধ্যে শস্য ফসলের বীজ, কৃষি বিজ্ঞান বিষয়ে ধারনা দিতে আমরা এই বীজ লাইব্রেরিটি সচল রাখতে সদা সর্বদা সহযোগিতা করবো। কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন বই পুস্তক ও জ্ঞান দিয়ে সহায়তা করবে উপজেলা কৃষি অফিস।
উল্লেখ্য, এই বীজ লাইব্রেরিতে বরেন্দ্র অঞ্চলের দেশীয় প্রজাতির ধান, রবিশস্য ও সবজির বীজসহ প্রায় শতাধিক জাতের বীজ ও বীজ সম্পর্কিত তথ্য প্রদর্শন করা আছে। এছাড়া বীজ সম্পর্কিত চাষাবাদ এবং আদান প্রদান বিষয়ে বরেন্দ্র কৃষক বীজ ব্যাংক সবসময় সহায়তা করবেন।