অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরলেন ইয়াসিন
রাজশাহী থেকে রাফি আহমেদ
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাই বলে কি মানুষ কোন ভুল করে না? এই ভুলকে শুধরেও নিতে পারে নিজের ইচ্ছা ও চাহিদায় । এই কারণেই হয়তো মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হয়েছে।
ইয়াসিন শেখের জীবনের গল্পটা খানিকটা এমনই । তার বয়স ৩০ বছর। একজন বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষ তিনি। আর সাধারণ পাঁচ দশটা স্বাভাবিক মানুষের মত তাঁর জীবনটা অতটা স্বাভাবিক নয়। অতটা সুখের নয়। সময়ের ব্যবধানে তার জীবনের যে পরিবর্তন ও পরিণতি তা সত্যিই অন্যন্ত মনোমুগ্ধকর। জীবনের যুদ্ধে তার অঙ্গহানী তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি অনেক কঠোর সংগ্রাম করে চলেছেন তার জীবনে।
কিন্তু কেন তার জীবনের এ পরিণতি! তা জানতে হলে তার জীবনের অতীতের পাতাগুলো উলটে দেখতে হয়।
তার অতীত আওড়ে জানা যায়, তিনি অত্যন্ত মেধাবী একজন শিক্ষার্থী ছিলেন। তার জন্মস্থান ফরিদপুর জেলায়। কৈশোরকাল শেষ হতে না হতেই তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাড়ি জমান দেশের রাজধানী ঢাকায়। সেখানে চলতে থাকে তার পড়াশুনা। এমন সময় তার পরিচয় হয় কিছু মানুষের সাথে । যাদের সঙ্গ প্রথমে ভালো লাগলেও পরবর্তীতে তা জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। নিজের থেকে বয়সে বড় মানুষদের সাথে গড়ে ওঠে তার চলাফেরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দ্বারা জোরপুর্বক তিনি মাদক সেবন করেন। সঙ্গ ছাড়তে চেয়েও তাদের প্রভাবের কারণে ছাড়তে পারেননি। এভাবে একদিন দুদিন যেতে যেতে একসময় তার মাদকের প্রতি আসক্তি জন্মে যায়। মাদকাসক্তি নামক যৌবনকালের সবচেয়ে ভয়ংকর রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন তিনি ।
মাদকের অর্থ জোগাতে লিপ্ত হন নানা ধরনের অসামাজিক কর্মকান্ডে। এমনভাবে পড়াশুনোটাও তাঁর বন্ধ হয়ে যায়। জীবন এ এক নতুন মোড় নেয় তার। বদলে যায় জীবনযাপন। এরই ধারাবাহিকতায় মাদকাসক্ত হয়ে নিজের অজান্তেই ট্রেনে করে পৌছে যান চট্টগ্রামে। অচেনা শহর, অচেনা মানুষ, অচেনা পথঘাট। মাদক সেবন করতে করতে এতটাই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে যান যে, মাদক না পেলে তার পাগল্প্রায় দশা হয়ে পড়ে। স্টেশনের লাইনে প্রায় পাগল অবস্থায় মাদকের নেশায় বিভোর হয়ে চলতে চলতে আছড়ে পড়েন। নিজে থেকে আর উঠে আসতে পারেননি। মর্মান্তিকভাবে ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। একটি পা ও একটি হাত কাটা পড়ে।
প্রায় ৬ মাস হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের পর ফিরে যান বাবা মায়ের কাছে। সেখানেও সমাজ তাকে জায়গা দেয় না। প্রচন্ড তাচ্ছিল্যতার সাথে বিতাড়িত হয়ে তিনি তার এক শুভাকাংখীর মাধ্যমে রাজশাহীতে আসেন। এখানে এসে নতুনভাবে শুরু করেন জীবন। মাস দুয়েক ভিক্ষা করেন শহরের অলিতে গলিতে। ভিক্ষাবৃত্তি তার প্রচন্ড অপছন্দ।
নিজের চেষ্টায় অল্প পুঁজি জমিয়ে একটি ছোট স্টল শুরু করেন। ভদ্রা পদ্মা আবাসিকের মাঝে বড় রাস্তার পাশে তার চায়ের স্টলটি। সারাদিন তিনি স্টলে বসে চা বিক্রি করেন। চা এর সাথে এখন তার দোকানে আরো অনেক খাবার সামগ্রী ও পাওয়া যায়। প্রতিদিন তার দোকানে ভিড় জমায় বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ।
তার জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, (তার ভাষায়) –‘আমার ভিক্ষা কইরতে ভালো লাগে না ভাইজান। ভাগ্যের মালিক ওপর ওয়ালা। আমি জীবনে অনেক কিছু দেখসি। আমি যে ওই পথ থেইকা ফিইরা আসছি এটাই আমার কাসে অনেক কিছু। নিজের সাধ্য অনুযায়ী পরিশ্রম কইরা ডাল ভাত জুটলেই আমি খুশি। দুই দিনের জীবনে আর কিছুই চাই না। কিন্তু আমি ভিক্ষা করতে চাইনা।’
ইয়সিনের বাবা মা এখন তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু তিনি যেতে চান না। তিনি কারো করুণার পাত্র হয়ে বাঁচতে চান না। তিনি এভাবেই জীবন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে পরিবারের লোকজন আসে তার কাছে। এতেই তিনি খুশি হন। সবাই এখন তাঁকে ভালোবাসে ও সম্মান করে। এই সম্মান নিয়েই বাঁচতে চান তিনি। জীবন যুদ্ধে অপরাজিত সৈনিকের মত লড়ে চলেছেন তিনি। শত প্রতিকূলতার মাঝেও আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে।
তিনি ভুল করেছেন ঠিকই। কিন্তু তা শুধরেও নিয়েছেন। কোন প্রতিবন্ধকতাই তাকে আটকে রাখতে পারেনি। মানুষের দুয়ারে তিনি হাত পাততে চান না। করে নিয়েছেন নিজের উপযোগী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। উদ্যম আর অধ্যবসায় থাকলে মানুষ কি ই না পারে!
মাদক সমাজের এক ক্যান্সারের নাম। যার প্রধান শিকার হচ্ছে যুব সমাজ ও ছাত্রসমাজ। মাদক প্রতিনিয়তই নষ্ট করে দিচ্ছে শত শত জীবন। সবাই পারে না ইয়াসিনের মত করে ফিরে আসতে।
কাজেই আমাদের সকলের নিজের অবস্থান থেকে মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে বদ্ধপরিকর হয়ে একত্রিত হতে হবে। তাহলেই এদেশ হয়ে উঠবে আরো সুন্দর ও সাবলীল।