অচাষকৃত উদ্ভিদ ও নতুন প্রজন্ম

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

বাড়ির উঠোন পেরিয়ে দেউরির (গ্রামের বাড়িতে ঢোকার প্রবেশ পথ) বাইরে গিয়ে আশেপাশে তাকালেই চোখে পড়ে হেইচা শাকের বাদার। আরেকটু এগিয়ে পথের দু’ধারে তাকালে পাওয়া যায় কচু শাক। পুকুর পাড়ে অনাদরেই বেড়ে উঠে মুঠো ভরা হেলেঞ্চা, কলমি। আর বিল, ঝিলে ফুটে থাকে শাপলা, কেউরালির ঝাঁক। এই চিরচেনা রূপ আমাদের গ্রাম বাংলা ছাড়া কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না।
বর্ষা মৌসুমে জলজ অচাষকৃত উদ্ভিদ যেমন শাপলা, কেউরালি, কলমি, হেলেঞ্চা ইত্যাদি পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে। তবে কলমি আর হেলেঞ্চা শাক মাটিতেও জন্মায়। কিন্তু পানিতে জন্মানো শাকগুলো হয় বেশ লতানো এবং নরম।


আষাঢ়, শ্রাবণ বর্ষাকাল। সে সময় থেকে এখনে পর্যন্ত বৃষ্টি হচ্ছে। তাই নেত্রকোণা এলাকার বিল, ডোবা, পুকুর, হাওড় পানিতে থৈ থৈ। এই পানিতেই জন্মেছে বিভিন্ন অচাষকৃত উদ্ভিদ। যেগুলো বর্তমানে আমাদের খাবারের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাচ্ছে। এক শ্রেণির মানুষ কলমি, শাপলা এগুলো বিল থেকে সংগ্রহ করে শহরে বিক্রি করতে নিয়ে আসেন। তার বিনিময়ে প্রাপ্ত টাকায় সংসারের প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপকরণ কিনে নিয়ে যান।


আমরা সব সময়ই জানি অচাষকৃত উদ্ভিদ অনেক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। যেগুলো বিনা চাষে, বিনা যতেœ প্রকৃতিতে বেড়ে উঠে। বহু বছর ধরে আমাদের খাবারের পাশাপাশি অসুখ বিসুখের প্রাথমিক চিকিৎসায়ও এগুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শুধু মানুষই নয়, বিভিন্ন প্রাণিসম্পদের খাবার ও চিকিৎসায় অচাষকৃত উদ্ভিদের ব্যবহার খুই গুরুত্বপূর্ণ।
করোনাকালীন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা বেশ আনন্দেই সময় পার করছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে খেলাধূলা, পাড়ায় বা পথের ধারে ঘুরে বেড়ানোতে আত্মহারা। নতুন চোখে সব কিছুই দেখতে চায়। তাই তো চোখের সামনে কোনো ডোবায় জন্মে থাকা কলমি শাকও তাদের নজর এড়ায়না। খেলার সাথীদের নিয়ে যে কোনো উপায়ে সেই শাক সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে যায়।


লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামের তাসমিন। কোনো একদিন বন্ধুদের সাথে খেলতে খেলতে রাস্তায় চলে আসে। সেখানকার একটি ডোবায় দেখতে পায় কলমি শাক। কিন্তু পানিতে নামার সাহস পায় না। তাই ছোট একটি বাঁশ যোগাড় করে সেটির সাহায্যে কলমি শাকের লতা সংগ্রহ করে সে। দু দিন ধরে শাক সংগ্রহ করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। তার মা সেই শাক রান্না করে দেন।


কান্দাপাড়া গ্রামের মিলি, খেলার সাথীদের নিয়ে রাস্তার ধার ও পুকুর পাড়ে জন্মানো কচু গাছ থেকে কচুর লতি সংগ্রহ করে। পরে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে প্রত্যেকের বাড়িতে নিয়ে যায়। এই লতি দিয়ে তাঁদের পরিবারের এক বেলার খাবারের চাহিদা মিটে যায়।


খাবারের অনেক উপাদান আছে। শাক, মাছ, দুধ, ডিম, মাংস ইত্যাদি। যেগুলো সংগ্রহ করতে অনেকসময় টাকার প্রয়োজন হয়। তবে গ্রাম বাংলায় যত ধরণের খাবার পাওয়া যায় তার মধ্যে অচাষকৃত উদ্ভিদ অন্যতম। যেগুলো টাকার বিনিময়েও পাওয়া যায় না। গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা এমনিতেই অচাষকৃত উদ্ভিদ ব্যবহার করে অভ্যস্ত। তাঁদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কোনো না কোনো অচাষকৃত শাক থাকে।


মিলি, তাসমিন এর মতো অনেক ছোট শিশুরা বড়দের পাশাপাশি অচাষকৃত উদ্ভিদ সংগ্রহ করছে। তারা শিখেছে কোনগুলো খাওয়া যায় আর কোনগুলো ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। শুধু তাই নয়, খাবারের পাশাপাশি এগুলো তারা সংরক্ষণও করে। মিলি যখন দেখে কেউ কচু গাছ বা পুকুর পাড়ের হেলেঞ্চা কেটে নিয়ে যাচ্ছে, তখন সে বাধা দেয়। সে ছোট বলে অনেকেই তার কথা শুনতে চায় না। তখন সে বাড়ি থেকে তার দাদীকে ডেকে নিয়ে আসে। কচু শাক আর হেলেঞ্চা গ্রামাঞ্চলে গরুর খাবার হিসেবেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাই অনেকেই এগুলো সেই উদ্দেশ্যে কেটে নিয়ে যায়।


আমাদের চর্চা, খাদ্যাভ্যাস এগুলো বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। পরিবার, সমাজ ছোটদের শিখিয়ে দিচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য। নতুন প্রজন্ম জানতে পারছে স্থানীয় খাবারের পুষ্টিগুণ। বড়দের হাত ধরেই তারা প্রকৃতিকে জানতে পারছে। প্রকৃতির বিশালতা থেকে নিতে পারছে সুস্থ থাকার নির্যাস।

happy wheels 2

Comments