আমার মরণের পরেও যেন মানুষ আমারে স্মরণ করে…

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

আমরা বহু বছর ধরে জেনে আসছি নারীরা অনেক কোমল স্বভাবের হয়। পরিবারের সবাইকে মায়া মমতায় জড়িয়ে রাখেন। নিজে কষ্ট সহ্য করে হলেও অন্যদের ভালো রাখার চেষ্টা করেন। সারাজীবন অন্দর মহলে থেকে কিসে সকলের ভালো হয় সেই ভাবনাতেই সময় কাটে তাঁদের।


সময় পাল্টেছে, বদলাচ্ছে পৃথিবী। এখন আর নারী ঘরের কোণে আবদ্ধ থাকার মানুষ নয়। সে বাইরের জগতে বিচরণ করতে শিখেছে, শিখেছে ন্যায় অন্যায়। প্রতিবাদের ভাষাটাও আজ রপ্ত করেছে খুব স্বাভাবিকভাবেই। তাই একদিকে মমতা আর অন্যদিকে শাসন এই দুই রূপেই নারী এখন পরিচিত।


লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের গদাইকান্দি গ্রামের আঞ্জুমান আরা আক্তার বেবী। তবে সবার কাছে তিনি বেবী আপা নামেই পরিচিত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি চার ছেলে ও এক মেয়ের জননী। অত্যন্ত সাদাসিধে ধরণের সদা হাস্যোজ্জল মানুষটি সকলের প্রিয়মুখ। নিজ গ্রাম ও গ্রামের বাইরে, যে কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে সবার আগে তিনি ছুটে যান। নিজের সাধ্যমতো সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন।


তিনি দুই মেয়াদে লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের ওয়ার্ড মেম্বার ছিলেন। সেই সময়ে তিনি নিজের গ্রামে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। গ্রামের রাস্তা প্রশস্তকরণ, টিউবওয়েল স্থাপন করেছেন। এছাড়া সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিধবাভাতা, বয়স্কভাতা ইত্যাদি বিতরণ করেছেন।


গ্রামের কোনো পরিবারে পারিবারিক ঝগড়া বিবাদ মেটানো, আচার অনুষ্ঠানের তদারকি করা সকল কাজে এখনো তাঁর ডাক পড়ে। তিনি সকলকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে যান। কেউ কোনো প্রয়োজনীয় উপকরণ তাঁর কাছে চাইতে এলে তিনি কখনোই তাঁদের ফিরিয়ে দেন না। সাধ্যমতো সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন।


তিনি করোনাকালীন মুহুর্তেও গ্রামের সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে সুস্থ ও সচল রাখার কাজ করছেন। দেশে যখন করোনা ভাইরাসের আক্রমণের ভয়াবহতার কথা শোনা যায় তখন থেকেই তিনি নিজ গ্রামের মানুষদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা শুরু করেন। গ্রামের উদ্যোগি যুবকদের নিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেন। এই দলের মাধ্যমে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে সবাইকে ভাইরাসের লক্ষণ ও করণীয় সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পরামর্শ প্রদান করেন। স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যদের সাহায্যে গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়ির খোঁজ খবর নেয়া, বিভিন্ন পরামর্শ প্রদানের কাজটি চালিয়ে যান। গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দেয়ার পাশাপাশি তিনি ব্যক্তিগতভাবেও সহযোগিতা করেন।


শুধু গ্রামে নয়, তিনি তাঁর পবিারের সদস্যদের জন্যও আলাদাভাবে থাকার ব্যবস্থা করে। প্রত্যেকের খাবারের প্লেট, গ্লাস এমনকি তাঁরা যে জায়নামাজে বসে নামাজ পড়েন সেটিও আলাদা করে ব্যবহার করেন। প্রতিদিন গরম পানি, লাল চা খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন। শুধু নিজের পরিবারের জন্য নয়, গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদের এ বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করেন। করোনা ভাইরাস যেহেতু এখনো নির্মূল হয়নি তাই এই অভ্যাস এখনো তাঁর পরিবারে চলমান আছে।


তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদের বিভিন্ন পরামর্শ দেন। যেমন কোনো কাজ করার সাথে সাথে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, খালি পায়ে না হাঁটা, বাড়িতে জমে থাকা বৃষ্টির পানি দ্রুত পরিষ্কার করা, বাড়িতে জীবাণুনাশক স্প্রে করা, বাজার থেকে কিছু কিনে আনলে রোদে রাখা বা ধুয়ে ব্যবহার করা, সপ্তাহে অন্তত একদিন খাবারের বাসনকোসন গরম পানি দিয়ে ধোয়া, কারো খেয়ে রাখা খাবার বা পানি না খাওয়া, কারো সাথে মুখোমুখি হয়ে না বসা, একজনের কাপড় অন্যজনে না পড়া, প্রয়োজনে বাইরে কোথাও গেলে বাড়ি ফিরে পরিধেয় কাপড় সাবান ও গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিজে গোসল করা, বারবার গরম পানি খাওয়া ইত্যাদি।


গ্রামের কেউ কোনো অপরাধে (নেশা, চুরি করা) জড়িয়ে পড়লে তিনি প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করেন। এতে কাজ না হলে তিনি আইনের সহযোগিতায় অপরাধ দমন করেন। এভাবে তিনি গ্রামের শান্তি শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন।
একজন নারী যেমন সারাদিন সংসারের কাজ করছেন তেমনি এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত হয়ে সংসারের উন্নয়নে প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কেউ আবার সামাজিক কাজে যুক্ত হয়ে নিজের গ্রামের পরিবেশ ভালো রাখার পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের সুস্থতা নিশ্চিত করছেন। এসমস্ত নারীরাই আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব।

happy wheels 2

Comments