নাজমা আক্তার পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন সবজি চাষ করে
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
কৃষি প্রধান দেশ বাংলাদেশ। এদেশের অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকার সবকিছুই কৃষির উপর নির্ভরশীল। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বর্তমানে কৃষি কাজ ছেড়ে দেশের বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত হচ্ছে। গ্রামীণ নারীরাই শুধু বয়স্ক পিতা-মাতা/শ্বশুর-শ্বাশুরী ও সন্তানদের নিয়ে গ্রামে রয়ে গেছেন। গ্রামে থেকে যাওয়া পরিবারের এসব সদস্যরা মূলত স্বামীর উপার্জনের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে বৈশ্বিক মহামারী করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত অনির্দিষ্টকালের লকডাউনে দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত অধিকাংশ পুরুষরা গ্রামে ফিরে কর্মহীন হয়ে অনাহার/অর্ধাহারে সময় কাটাতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে গ্রামীণ নারীরা সংসারের হাল ধরে বসতভিটার সামান্য জমিতে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ, গবাদি পশু-পাখি পালন করে পারিবারিক আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে। নারীরা গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি বসতভিটায় বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করে দৈনন্দিন পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাজারে বিক্রি করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
নেত্রকোনা সদর উপজেলা কাইলাটি ইউনিয়নের মৌজেবালি গ্রামের কৃষাণী নাজমা আক্তার তাদেরই একজন। এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান নিয়ে চল্লিশোর্ধ বিধবা নাজমা আক্তারের তিনজনের ছোট সংসার। ১৮ বছরের সংসার করে ২০১৬ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর দুই সন্তান নিয়ে অনেক কষ্টে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে সংসার চালাতে থাকেন নাজমা আক্তার। মৃত্যুর সময় স্বামী রেখে যান বাড়িভিটাসহ ৩০ শতাংশ জমি। এই সামান্য জমিতে নাজমা আক্তার সবজি চাষ করে কোনভাবে সংসারের চাহিদা মিটাতে থাকে। ২০১৯ সালে বারসিক’র সহযোগিতায় উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে দুই মাস মেয়াদী সেলাই প্রশিক্ষণ শেষে অনেক কষ্টে একটি সেলাই মেশিন কিনে গ্রামের নারী ও শিশুদের পোষক সেলাই করে যে আয় হয় তা দিয়েই সংসারের হাল ধরেন।
এপ্রিল ২০২০ থেকে করোনা সংক্রমণ রোধে সারা দেশে লকডাউন থাকায় সেলাইয়ের কাজও কমে গিয়ে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তাই লকডাউন চলাকালীন সময় থেকে তিনি পারিবারিক চাহিদা পূরণে সেলাই কাজের পাশাপাশি কৃষি কাজের সাথে সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েন। লকডাউনে স্কুল বন্ধ থাকায় দুই ছেলে-মেয়ের গ্রামের কৃষক বীজঘর থেকে ১০ জাতের সবজি বীজ এবং আদর্শ কৃষক আবুল কালামের পরামর্শ নিয়ে বসতভিটায় চাষ করেন। ২০২০ সালের করোনাকালীন সংকটের সময়ে লাউ, সীম, আলু, ডাটা, মূলা, টমোটো, বারোমাসি মরিচ, পেঁপে, বারোমাসি বেগুন, বরবটি চাষ করে পরিবারের চাহিদা মিটিয়েও বাজারে বিক্রি করে প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় করেন। নাজমা আক্তার নিজের চাষকৃত সবজির বীজ সংরক্ষণ করে গ্রামের অন্যান্য কৃষক-কৃষাণীদের সাথে সবজি বীজ বিনিময় করেন এবং প্রতিটি জাতের সবজির বীজ কিছু কিছু করে গ্রামীণ বীজ ঘরে সংরক্ষণের জন্য প্রদান করেন।
চলতি বর্ষা মৌসুমে তিনি পুনরায় বীজ ঘর থেকে বৈচিত্র্যময় ১৩ জাতের (ঢেড়স, পুইশাক, বরবটি, পাটশাক, কলমিশাক, লালশাক, পেঁপে, বারোমাসি মরিচ, কুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, ডাটা, বেগুন) সবজি বীজ নিয়ে বসতভিটায় চাষ করেছেন। নাজমা আক্তার চলতি মৌসুমে কুমড়া, ঢেড়স, পাটশাক, পেঁপেসহ ৯ হাজার টাকায় সবজি বিক্রি করেছেন। নিজের উৎপাদিত শাক্সবজি থেকে দৈনিক তিন বেলা পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করছেন। ঢেড়স বীজ সংরক্ষণ করেছেন প্রায় ৩ কেজি। ৫টি কুমড়া বীজের জন্য সংরক্ষণ করেছেন। তার বসতভিটায় এখনও প্রচুর সবজি রয়েছে। স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ, বীজ উৎপাদন, বীজ সংরক্ষণ, বীজ বিনিময় এবং পরিবেশসম্মত উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের অভিজ্ঞতা ও কৌশল সম্পর্কে গ্রামীণ নারীদের সাথে নিয়মিত সহভাগিতা করছেন এবং পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
সবজি চাষের সফলতা সম্পর্কে কৃষাণী নাজমা আক্তার বলেন, ‘বীজ কৃষকদের অন্যতম প্রধান সম্পদ, আল বীজ থেকেই ভালো বীজ পাওয়া যায়। তাই আমরার বীজ আমরারই রক্ষা করণ লাগবো। বীজ সংরক্ষণের লাইগ্যা আমারা সংগঠনের উদ্যোগে বীজঘর বানাইছি। আমরার যাতে বীজের জন্য কোন কষ্ট না হয় তার লাইগ্যা সব জাতের বীজ আমরা নিজেরাই সংরক্ষণ করতাছি। নিজেরার বুদ্ধিমত আমরা বীজ সংগ্রহ কইরা বীজ ঘরে রাখি। নিজেরার লাইগ্যা দরকারমত বীজ রাইখ্যা বাকী বীজগুলান বীজঘরে রাখি। আমরার অহন বাজার থাইক্যা বেশি বীজ কিনতে অয়না, আমরার বীজঘরে যেসব বীজ থাহেনা শুধুমাত্র সেগুলাই বাজার থাইক্যা কিইন্যা আনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা গ্রামের সকল কৃষক-কৃষাণী সিদ্ধান্ত নিছি যে, আমরা বেবাকে যার যার ক্ষেতের বীজ রাখবাম আর বীজ বিনিময় কইরা যার যে জাতের বীজ নাই সেই জাতের বীজ সংগ্রহ করবাম। বেবাকে গোবর সার ও মূরগীর লেদা দিইয়া পরিবেশের কোন ক্ষতি না কইরা সবজি চাষ করমু আর বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি ফলামু। আমি সবজির পোকা দমনে বারসিক থেইক্কা জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক তৈরিকরণ শিইখ্যা অনেক উপকার পাইছি। বসতভিটায় সবজি চাষ না করলে আইজ করোনাকালিন সময়ে আমার পোলাপাইন লইয়া না খাইয়্যা থাকন লাগত।’
বৈশ্বিক মহামারী করোনা সংক্রমণ সারা দেশের খেটে খাওয়া দরিদ্র পরিবারগুলোর স্বাভাবিক জীবনযাপন স্তম্ভিত করে দিয়েছে। করোনাকালীন সংকটে গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোর আয় আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় স্বাভাবিক জীবনযাপনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের এমন পরিস্থিতিতে নাজমা আক্তাররা সরকারী/বেসরকারী সেবা পরিসেবাসমূহের জন্য বসে না থেকে নিজের সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে (বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ, গবাদী পশু-পাখি পালন) পারিবারিক আয় বৃদ্ধি করে চলেছে। কঠোর পরিশ্রম করে তারা নিজ নিজ পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি এলাকার ভোক্তাদের খাদ্য নিরাপত্তায়ও ভূমিকা রেখে চলেছেন। পরিবেশবান্ধব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণের মাধ্যমে বৈশ্বিক মহামারী করোনা মোকাবেলায় সক্ষম হচ্ছে।
.