ভারী বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে হাওর এবং সীমান্ত অঞ্চলের জনজীবন ও প্রাণসম্পদ আজ ভয়াবহ বিপর্যয়ে
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
১৬ জুন ২০২২ বিকাল থেকে ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজের সাথে সাথে নেত্রকোনা অঞ্চলে দিনরাত অবিরাম ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে ১৭ জুন ২০২২ ভোর রাত থেকে সারাটা দিন জেলার কলমাকান্দা, দূর্গাপুর, মোহনগঞ্জ, আটপাড়া, খালিয়াজুড়ি ও মদন উপজেলার জন্য ছিল এমনই এক ভয়াবহ দিন। এই দিন ভোর রাতে এসব অঞ্চলের সমস্ত ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, হাটবাজার পানিতে ডুবে যায়। পাহাড়ি ঢলের প্রবল বেগের সাথে গাছপালা ভেসে যাওয়ার প্রকট শব্দে ও গবাদী পশু-পাখি ডাকাডাকিতে ঘুমিয়ে থাকা গ্রামবাসীরা জেগে উঠে উঠানে বের হয়ে বাড়ির উঠানসহ সমস্ত এলাকা পানিতে প্লাবিত দেখতে পায়। অনেকে আবার ঘুম থেকে জেগে খাটের উপর থেকে নিচে পা ফেলেই ঘরের ভেতর পানির অস্তিত্ব জানতে পারে। উজান থেকে (ভারতের মেঘালয় ও আসাম থেকে) ভেসে আসা পাহাড়ি ঢলের তান্দবে দূর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলাসহ আটপাড়া, মোহনগঞ্জ, বারহাট্টা এবং মদন উপজেলার হাওরাঞ্চল হঠাৎ পানিতে তলিয়ে যায়। পানিতে তলিয়ে সীমান্ত এলাকা ও হাওরাঞ্চলের কাঁচা ঘরবাড়ি, বসতভিটা, কৃষি জমি ও বসতভিটায় চাষকৃত সমস্ত ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সীমান্ত এলাকায় ভারতের পাহাড় থেকে ঢলের সাথে ভেসে আসা বালি, পাথর ও গাছের আঘাতে নদী ও ছড়ার বাঁধ ভেঙ্গে সীমান্ত এলাকার সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঢলের ¯্রােতে দূর্গাপুরের সোমেশ্বরী, কলমাকান্দার গণেশ্বরী, মহাদেও, তাহিরপুরের যাদুকাটা নদীসহ ছোট ছোট ছড়ার বাঁধ ভেঙ্গে বালি ও পাথরে ঢেকে দূর্গাপুর, কলমাকান্দা, তাহিরপুর, বিশম্ভরপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকার কয়েক শতাধিক একর কৃষি জমি ও বসতভিটার জমি চাষের অনুপযোগি হয়ে পড়েছে। বালি ও পাথর ঢেকে রাস্তাঘাট চলাচলের অনুপযোগি হয়ে পড়েছে। পাহাড়ি ছড়া ও নদীতে বালির স্তুপ পড়ে পানির সাভাবিক গতিপথ বন্ধ হয়ে গেছে।
বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ী ঢল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠীর জন্য এক আতঙ্ক। প্রতিবছরই বর্ষার শুরু থেকে শেষ অবধি সীমান্ত এলাকায় এক-দুইবার বা তারও বেশি পাহাড়ি ঢল হয়ে থাকে। সাধারণত বছরের মে-জুলাই এর মধ্যে বেশ কয়েকবার পাহাড়ি ঢল হয়। কোন কোন পাহাড়ি ঢল শান্তভাবে নদী উপচে এলাকার রাস্তাঘাট, বসতবাড়ির উঠান কৃষি জমি পানিতে প্লাবিত করে। আবার কোন কোন পাহাড়ি ঢল ধ্বংসাত্মক রূপ ধারণ করে নদী ও ছড়ার বাঁধ ভেঙ্গে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ভেঙ্গে নিয়ে যায় সীমান্ত এলাকার রাস্তাঘাট, কালভার্ট, ঘরবাড়ি ও বসতভিটা, ডুবিয়ে নষ্ট করে মাঠের ফসল, ভাসিয়ে নিয়ে যায় নদীর পাড়ের গাছপালা, আবার ঢলের সাথে পাহাড়ি বালি ও পাথর এসে কৃষিজমি বালি ও পাথরে ঢেকে মরুভূমিতে পরিণত করে। বর্ষার শেষে ভেঙ্গে যাওয়া রাস্তাঘাট, নদী ও ছড়ার বাঁধ সংস্কার করা হলেও পরবর্তী বর্ষা মৌসুমেই আবার পাহাড়ি ঢলে ভেঙ্গে যায়। এবছর নদী বা ছড়া একদিকে পার ভাঙ্গে তো পরের বছর অন্যদিকে ভাঙ্গে।
স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের সাথে কথা বলে ও বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ১৬ জুন থেকে একাধারে ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে রেকর্ড পরিমাণ ভারি বৃষ্টিপাত হয়। প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়। গণমাধ্যম সূত্রে প্রবল বন্যায় আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে বেশ কিছু সংখ্যক লোকের মৃত্যু ঘটেছে বলে জানা যায়। মেঘালয় ও আসাম রাজ্যের পাদদেশে হওয়ায় নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত এলাকায় দিনরাত ভারি বৃষ্টিপাত হয়। আসাম ও মেঘালয়ে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ে জমে থাকা পানি প্রবলবেগে পাহাড়ী ঢলে পরিণত হয়ে ভারতের পাহাড় থেকে বয়ে আসা বিভিন্ন নদী (সোমেশ্বররী, গণেশ্বরী, যাদুকাটা, সুরমা নদীসহ ছোট ছোট পাহাড়ী ছড়া) উপচে সীমান্তের সমস্ত রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি জমি তলিয়ে দেয়। ঢলের সাথে ভেসে আসা বাঁশঝাড়, বড় বড় গাছ, ভারতের বেইলীব্রীজ ভেসে এসে সীমান্ত এলাকায় নদী ও ছড়ার উপর নির্মিত কালভার্ট ও ব্রীজে আটকে পানির ¯্রােতকে বাঁধাগ্রস্ত করার ফলে পানির প্রবল ¯্রােত নদী ও ছড়া পাড় ভেঙ্গে বসতভিটাসহ সকল কৃষি জমি বালি ও পাথরে ঢেকে গেছে। স্থানীয়দের মতে, ১৭ জুনের ইতিহাসের স্মরণকালের পাহাড়ী ঢলে সীমান্ত এলাকার প্রায় কয়েকশত বিঘা জমি সম্পূর্ণ ভাবে চাষের অনুপযোগি হয়ে পড়েছে এবং অসংখ রাস্তা ও কালভার্ট ভেঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
জানা যায় কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুড়া ইউনিয়নের উপর দিয়ে বয়ে চলা গণেশ্বরী নদীতে বিএডিসি নির্মিত লেংগুড়া ব্রীজ ও রাবার ডেমের সাথে পাহাড়ি ঢলের সাথে মেঘালয় থেকে ভেসে আসা বেইলী ব্রীজের অংশ, বাঁশের ঝাড় ও গাছপালা আটকে ¯্রােতের দিক পরিবর্তন করে ফুলবাড়ি গ্রামের অংশে, চৈতানগর, তারানগর, বালুচড়া, নলছাপ্রা, গ্রামের নদীর পাড় ভেঙ্গে অনেক কৃষিজমি বালিতে ঢেকে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক বসতভিটার কৃষি ফসল।
কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামবাসী সূত্রে জানা যায়, পাহাড়ি ছড়ার বাঁধ ভেঙ্গে ও সীমান্ত ঘেষা ভারতের পাহাড় ধ্বসে চন্দ্রডিঙ্গা, বেতগড়া, শিংকাটা, পাঁচগাও, জাগিরপাড়া গ্রামের কয়েকশত বিঘা কৃষি জমি কয়েক ফুট বালি ও পাথরে ঢাকা পড়ে চাষের অনুপযোগি হয়ে পড়েছে। ফলে এসব জমি আমন ২০২২ মৌসুমে সম্পূর্ণ পতিত পড়ে থাকবে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। আদিবাসী কৃষক সুবিমল ¤্রং জানান,“১৬-২০ জুনের ভারি বৃষ্টিতে পাহাড় ধ্বস ও পাহাড়ি ঢলে শুধুমাত্র তার নিজের প্রায় ৩.০০ একর কৃষি জমি বালি ও পাথরে ঢাকা পড়ে চাষের অনুপযোগি হয়ে পড়েছে। এসব বালি ও পাথর অপসারণ না করলে আর চাষাবাদ করা যাবেনা। এসব বালি ও পাথর অপসারণে অনেক টাকার প্রয়োজন, যা আমার মত সাধারণ কৃষকের পক্ষে অসম্ভব।” একই ইউনিয়নের বরুয়াকোনা গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে চলা মহাদেও নদীর বাঁধ ভেঙ্গে ও পাহাড় ধ্বসে কচুগড়া ও সন্ন্যাসীপাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের অনেক কৃষি জমি ও রাস্তা বালি ও পাথর পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানা যায়। দূর্গাপুর উপজেলাবাসী সূত্রে জানা যায়, ১৭ জুন পাহাড়ি ঢলের প্রবল ¯্রােতে সোমেশ্বরী নদীর পাড় ভেঙ্গে কামাখালী, শিবগঞ্জ ও রানীখং এর ব্যাপক এলাকার কৃষি জমি ও বসতভিটা বালিতে ঢেকে গেছে এবং অনেক রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সীমান্ত অঞ্চলের আদিবাসী প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান যে, তাদের বাপ-দাদার মূখে পূর্বে পাহাড়ি ঢল ও পাহাড় ধ্বসে ক্ষয়ক্ষতির অনেক কথা তারা শুনেছেন, কিন্তু ১৭ জুন ২০২২ এর ক্ষয়ক্ষতি পূর্বের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তাদের মতে, বংশ পরস্পরায় বাপ-দাদার কাছে শুনে আসা কথামত পাহাড়ি ঢল ও পাহাড় ধ্বসে ক্ষয়ক্ষতির রেকর্ড অনুযায়ী একশত বছরের মধে এত ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এবারের দূর্যোগে কাঁচা ঘরবাড়ি ধ্বসে গেছে, টিনের ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
স্থানীয় অধিবাসীরা এবারের পাহাড়ি ঢলের ব্যাপক তান্দবের জন্য মেঘালয়ের পাহাড় থেকে বয়ে আসা সোমেশ্বরী, গণেশ্বরী, মহাদেও, যাদুকাটা নদীসহ পাহাড়ী ছড়াগুলো থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালি ও পাথর উত্তোলন এবং হাওরে অপরিকল্পিত ও দূর্বল ফসল রক্ষা বাঁধকে দায়ি করেন। তাদের মতে, নদীগুলোর অনেক গভীর পর্যন্ত মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের জন্য খনন করে নদীর মাঝখানে বালি স্তুপ করে রাখায় ঢল সেই বালির স্তুপে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে নদীর পার ভেঙ্গে বসতভিটা ও কৃষি জমির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। তারা আরও জানায়, পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে বালির স্তুপ করে রাখা না হলে ঢলের পানির ¯্রােত নদী বরাবর বয়ে ভাটিতে চলে যেত। কিছু পানি নদীর পাড় উপচে বসতবাড়ি ও কৃষি জমি প্লাবিত করলেও বালি পড়ত না।
সীমান্ত অঞ্চলের (নাজিরপুর, লেঙ্গুড়া, রংছাতি ইউনিয়ন) কৃষকরা কিছু দিন আগেই আমন মৌসুমের জন্য বীজতলায় বীজ বপন করেছিলেন, কিন্তু পাহাড়ি ঢলের পানিতে ও বালিতে তাদের সমস্ত বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে বলে কৃষকরা জানায়। এখন অধিকাংশ কৃষকদের হাতে কোন বীজ নেই। তাই আমন মৌসুমে বীজতলা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় বীজ সংগ্রহের ক্ষেত্রে তারা সমস্যায় পড়বেন বলে কৃষকরা জানায়। পাহাড়ি ঢল ও ভারি বৃষ্টিতে সৃষ্ট বনায় নেত্রকোনার কলমাকান্দা, দূর্গাপুর, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুড়ি, মদন, আটপাড়া, কেন্দুয়াসহ হাওরাঞ্চলের সমস্ত এলকার সবজি ক্ষেত ও বসতভিটার সবজি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।
বন্যায় হাওরাঞ্চলের জনদূর্ভোগ: নেত্রকোনা অঞ্চলে ১৬ জুন ২০২২ থেকে বিরতিহীনভাবে একাধারে প্রায় পাঁচদিন ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে এবং উজান থেকে বয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে হাওরাঞ্চলে হঠাৎ বন্যা দেখা দেয়। রাতের মধ্যে নেত্রকোনার সমস্ত হাওরাঞ্চল (মদন, খালিয়াজুড়ি, মোহনগঞ্জ, আটপাড়া, কেন্দুয়া) পানিতে তলিয়ে যায়। হাওরবাসীদের ভাষ্যমতে, ১৬ জুন থেকে সারা দিন-রাত ভারি বৃষ্টির ফলে এক রাতের মধ্যেই ঘরে পানি ঢুকে যায়। ঘরে সংরক্ষিত ধান চাল, আসবাবপত্র পানিতে ভিজে যায়। ভোরের মধ্যে সকলে পরিবার পরিজন ও গবাদী পশু-পাখিগুলো ও কিছু মালামাল নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পারলেও অধিকাংশ মালামাল (আসবাবপত্র, খোরাকের ধান) নষ্ট হয়েছে সরিয়ে নিতে না পারায়। হাওরের মাঝখানে বসবাসরত অনেক পরিবার নৌকা বা অন্য কোন বাহন না থাকায় নিরাপদ স্থানে তাদের গবাদী পশু-পাখি, পরিবার পরিজন ও মালামাল নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বিলম্ব হয়। দিনের বেলায় অনেক কষ্টে পরিবারগুলো তাদের পরিজন ও গবাদী পশু-পাখি নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারলেও তাদের গবাদী পশুর জন্য সংরক্ষিত গো-খাদ্যগুলো (খড়) পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে হাওরাঞ্চলে মানুষের খাদ্যের চেয়ে গো-খাদ্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। বন্যার্ত মানুষের জন্য সরকার, বিভিন্ন বেসরকারী ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠন, দানশীল ব্যক্তিদের উদ্যোগে খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা হলেও গবাদী পশু-পাখির জন্য কেউ কোন ধরণের খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করেননি। ফলে গো-খাদ্যের অভাবে কৃষকরা তাদের গবাদী পশুগুলো খুবই কম মূল্যে বিক্রি করে দিতে বাধ হচ্ছে। অথচ বন্যা পরবর্তী সময়ে এসব গবাদি পশুগুলোই হাওরবাসীদেরকে উচ্চ মূল্যে কিনে পালন করতে হবে।
বারসিক মদন উপজেলার হাওরাঞ্চলের (মদন সদর ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়ন) পরিবেশ উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন ও অভিযোজনের জন্য কৃষক ও হাওরবাসীদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতার জন্য ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তিন বছর প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনা করে। হাওরাঞ্চলে বৈচিত্র্যময় গাছের বনায়ন ও হাওরে সবুজ বেষ্টনি গড়ে তোলার জন্য মদন সরকারি কলেজ থেকে উচিতপুর পর্যন্ত সড়কের দুই ধারে, গোবিন্দশ্রী ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় প্রাঙ্গন, গণেশের হাওর ফসল রক্ষা বাঁধ, গোবিন্দশ্রী গুচ্ছগ্রাম, গোবিন্দশ্রী খালাসীপাড়া, বারঘরিয়া গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোর ভিটে সুরক্ষায় বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যবর্ধনকারী (কৃষ্ণচুড়া, কাঠবাদাম, সোনালু, কাঞ্চন ফুল, শিমূল, পলাশ ও পানি সহনশীল গাছের (হিজল, করচ ও মূর্ত্যা বেত) চারা রোপণ করা হয়। ফসল রক্ষা বাঁধে রোপণকৃত পানি সহনশীল গাছগুলো (হিজল ও করচ) পর পর তিন বছর পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে যাবার পর যেসব চারা টিকে ছিল সেগুলোও সাম্প্রতিক বন্যায় নষ্ট হয়ে যাবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। গোবিন্দশ্রী গুচ্ছগ্রামের ভিটে রক্ষায় গুচ্ছগ্রামের চারপাশে মূর্ত্যা, হিজল ও করচ গাছের চারা রোপণ করা হয়েছিল।
এছাড়াও বরাদ্দকৃত ৫০টি পরিবারের জন্য পেয়ারা, কাঁঠাল, সুপারি, নারিকেল, আম ইত্যাদি ফলের চারা বিতরণ করা হয়েছিল, যেগুলো তারা নিজ নিজ ঘরের সামনে রোপণ করেছিলেন। গাছগুলো ভালোভাবেই বেড়ে উঠেছিল। অধিকাংশ পেয়ারা ও আম গাছে এবছর ফল ধরেছিল। গুচ্ছগ্রামটির পুরোটাই সবুজ বেস্টনীতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের বন্যায় গুচ্ছগ্রামের এক তৃতীয়াংশ ডুবে যায়। গুচ্ছগ্রাম থেকে দ্রুত পানি নেমে না গেলে এবং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত গাছগুলো পানিতে ডুবে থাকলে সবগুলো ফলের চারা মারা যাবে বলে গুচ্ছগ্রামবাসী আশংকা করছেন। বন্যার পানি এতই বেশি হয় যে, গুচ্ছগ্রামের ঘরগুলো বসবাসের অনুপযোগি হওয়ায় সকল পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে বাধ্য হয়। গোবিন্দশ্রী ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গনে সৌন্দর্যবর্ধনকারী ও পানি সহনশীল গাছের চারা রোপণ করা হলেও পরপর তিন বছর পানিতে ডুবে যাওয়ায় সমস্ত চারা নষ্ট হয়ে গেছে। মদন সরকারি কলেজ থেকে উচিতপুর সড়কের দুই ধারের রোপণকৃত সৌন্দর্যবর্ধনকারী গাছগুলোর অনেকগুলোই অনেক বড় হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতিক বন্যার ফলে ট্রলারঘাট উপরে চলে আসায় ট্রলারের রশি গাছের সাথে বাঁধায় এবং হাওরের গবাদি পশু সড়কে বাঁধায় গাছগুলোর ক্ষতি হচ্ছে।
সীমান্ত এলাকা ও হাওরবাসীরা পাহাড়ী ঢল ও বন্যা থেকে তাদের বসতবাড়ি, কৃষি জমি ও রাস্তাঘাট রক্ষায় অবৈধভাবে বালিমহাল ইজারা বাতিল করে যত্রতত্র বালি ও পাথর উত্তোলন বন্ধ করা, নদী ও পাহাড়ি ছড়ার বাঁধগুলো পুনঃসংস্কার করা এবং হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধগুলো সুপরিকল্পিত, উঁচু ও মজবুত করে নির্মাণ করে বাঁধের স্থায়িত্বের জন্য এলাকা উপযোগি ও পানি সহনশীল বৈচিত্র্যময় গাছের বনায়নের দাবি জানান। দূর্যোগে নিরাপদ আশ্রয়ের জন সরকারি/বেসরকারি উদ্যোগে হাওরাঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা এবং যত দ্রুত সম্ভব ভেঙ্গে যাওয়া রাস্তাঘাট ও কালভার্টগুলো সংস্কার করে যোগাযোগ ববস্থা স্বাভাবিক করা। হাওরাঞ্চলে নির্মিত গুচ্ছগ্রামগুলো বনা সহনশীল, লোকালয় বা কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে ও সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা রয়েছে এমন জায়গায় নির্মাণের দাবি জানায়। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে কৃষকরা আমন মৌসুমে ধানের বীজ ও সবজি বীজের জন্য সরকারী/বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সহযোগিতা কামনা করেন।