সাম্প্রতিক পোস্ট

ভাঙনের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকে নদী পাড়ের মানুষ

মানিকগঞ্জ থেকে রুমা আক্তার

নদী পাড়ের মানুষদের কাছে এক আতঙ্কের নাম নদী ভাঙন। নদী ভাঙনের সাথে যুদ্ধ করেই টিকে থাকতে হয় তাদের। বাংলাদেশে প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন স্থানে নদী ভাঙনের শিকার হয়। এতে বসতভিটা জায়গা জমি সব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। বসতবাড়ি ও ভিটামাটি হারিয়ে অনেক পরিবার নদী ভাঙনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় পাড়ি দিচ্ছে অন্য শহর বা গ্রামে। এতে তাদের অভাব ও দরিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হচ্ছে। এমনই এক পরিবার হচ্ছে মানিকগঞ্জ শহরে কাছেই পাছবারইল গ্রামে ভাড়াটিয়া মোঃ ইউনুস শেখ ও চায়না দম্পতির পরিবার। কথা হয় ইউনুস ও চায়না দম্পতির সাথে।

মোঃ ইউনুস শেখের পৈত্রিক বসতবাড়ি ছিল মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার সুতানলি ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামে। মোঃ ইউনুস শেখের পিতা ছিলেন একজন কৃষক। আনুমানিক ৪৫ বছর আগে পদ্মা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে এই কোদালিয়া গ্রাম। বসতবাড়ি কৃষি জমি হারিয়ে পারি জমান হারুকান্দি গ্রামে।

তিনি বলেন, ‘হারুকান্দি গ্রামে যখন আসি, তখন আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। যাতায়াতের তো সুবিধা ছিল না, তখন তো মটরের নৌকা ছিল না। ছোট ছোট নৌকায় করে ঘরের চালসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র আনতে কষ্ট হয়েছে। তখন তো আমি ছোট। আমার বড় দুই বোন, আমি ছিলাম ৩য় আমার ছোট ছিল আরও তিনজন। এই বড় পরিবারের খাবার সংগ্রহই ছিল কষ্ট। তারমধ্যে নতুন করে ঘর তোলা, তার মাঝে কাজের ঠিক ছিল না। নতুন জায়গায় তো সমস্যা হবেই, বাড়ির মহিলাদের বেশি সমস্যা ছিল। তবে চিকিৎসার সমস্যা বেশি ছিল। আশেপাশে কোন হাসপাতাল ছিল না। আমি বাবার সাথে কাজ করতাম। বড় সংসার ছিল তাই অনেক কষ্ট হতো। তবুও ভালোই চলছিল। আবার ৮৮ বন্যায় আমাদের বসতবাড়ি নদী ভাঙনের কবলে পড়ে।’

ইউনুস শেখ আরও বলেন, ‘হারুকান্দির বাড়ি পদ্মা নদীতে চলে যায়, পাড়ি দিলাম ভেলাবাদে গ্রাামে। এখানে যখন আসি তখন তোমার কাকি (ইউনুস শেখের স্ত্রী) নতুন বউ। ভেলাবাদে এসে প্রথমে দুই তিন মাস অন্যের জায়গায় ছিলাম।’ তাঁর স্ত্রী চায়না আক্তার বলেন, ‘অন্যের জায়গায় কি আর নিজের মত শান্তিতে থাকা যায়। ইচ্ছে মত চলা যায় না, কোন গাছ লাগানো যায় না। কোন কিছু পালা যায় না। নতুন জায়গা তার মধ্যে টয়লেট ছিল দূরে, রাতে বের হতে ভয় পেতাম। কোন সবজি উৎপাদন করা যায় না। কত সময় আধ পেটা খেয়েও দিন কাটিয়েছি। যখন আবার একটু ভালো চলা শুরু করলাম। তখন আবার ২০০০ সালে নদী ভাঙনের কবলে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হই। নিজের বলতে কিছুই নাই। বউ বাচ্চা নিয়ে কোথায় থাকব।

কোন উপায় না পেয়ে এই দম্পতি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় ইউনুস রিকশা চালাতেন। সংসারে তখন স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে চারজন। সবার থাকা, পোশাক,চিকিৎসা ও খাবারের ব্যবস্থা করতে হতো। অভাবের জন্য ছোট ছোট ছেলে দুইটাকে প্রেসের কাজে দিতেন। অল্প বয়সের ছেলে দুটো পড়াশোনা করা বাদ দিয়ে সংসার চালানোর জন্য কাজ শুরু করল। তাদের খুব কষ্ট হতো ছেলে দুটোকে পড়াশোনা করাতে না পারায়। ইউনুস শেখ বলেন, ‘যে বয়সে খেলাধুলা করার সময়, সে বয়সে আমি তাদের কাজে দিছি। কিন্তু মেয়েটাকে পড়াইছি। আমি সারাদিন রিকশা চালিয়ে যা পাইতাম তা দিয়ে খাওয়া আর ছেলেদের টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া ও মেয়ের পড়াশোনার খরচ চলত। কিন্তু ঢাকার শহরে আমাদের মত গরীব মানুষদের বসবাস করাটা অনেক কঠিন। সব কিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে নিজেদের আয় অনুযায়ী ঢাকায় বসবাস করা কষ্ট হচ্ছিল। তাই ভাবলাম যদি কিছু টাকা জমিয়ে দেশে ফিরতে পারি তাহলে একটা কিছু করতে পারব। তাই অভাবের মাঝেও কষ্ট করে কিছু টাকা জমিয়ে ২০১৮ সালে মানিকগঞ্জ ফিরে আসি।’

বর্তমানে মানিকগঞ্জ শহরের কাছে পাছবারইলে ৫ বছর যাবৎ দুটো টিনসেট ঘর নিয়ে ভাড়া থাকেন ইউনুস শেখের পরিবার। এর মাঝে বড় ছেলেকে বিয়া দিয়েছেন। একঘরে তারা থাকে। ছোট ছেলে বাড়ি এলে তাকে নিয়ে তারা একঘরে থাকেন। ইউনুস বলেন, ‘আমাদেরও তো লজ্জা করে এত বড় ছেলের সাথে এক ঘরে থাকি। কিন্তু আরও একটা ঘর নিব তাতে তো আরও টাকার প্রয়োজন। এই ঘর দুটোর ভাড়া দেই প্রতি মাসে ২০০০ টাকা। আমাদের সংসার খরচ তো আছেই। বড় ছেলের ঘরে নাতি হইছে। তার পিছনেও তো কিছু খরচ আছে। (নাতি) তার পোশাক, অসুখের খরচ, তেল-সাবান ছাড়াও প্রতিদিন দোকানের খাবার খায় তার খরচ।’

এর মাঝেও ২০২০ সালে মেয়েটার বিয়ে দিয়েছেন ইউনুস শেখ। তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, ঋণ না করলে কি কোন কাজ করতে পারি। ঋণ করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। শান্তনা মেয়েটা এখন সুখে আছে। এরপর দুই ছেলের সাথে পরামর্শ করলাম যে, প্রতিমাসে আমাদের অনেক টাকা ঘর ভাড়ায় চলে যায়। আবার অন্যের বাড়িতে নিজের মত থাকা যায় না। ছোট ছেলেরও বিয়ে দিতে হবে । তাই মেয়ে বিয়ের ঋণ পরিশোধ করে আবারও ঋণ করে বেংরুই গ্রামে ছোট একটু জমি নিয়েছি। এই ঋণ এখনো শেষ হয় নাই। এরপর কিছু টাকা জমিয়ে একটা ঘরের চাল তুলেছি। কিন্তু আর কিছু করার টাকা নাই। খালি তো ঘর তুললেই হয় না। পরিবারের মহিলাদের থাকার জন্য একটা রান্না ঘর, টিউবওয়েল, টয়লেটও তো লাগবো। কোথায় পাব এত টাকা। তবুও ভাবছি এত কষ্টের মাঝেও তো নিজের একটা স্থান হল। এত বছর তো নিজেদের কোন স্থান ছিল না, অন্যের জায়গায় বসবাস করলাম!’ নদী পাড়ের মানুষের জীবন নদী ভাঙনসহ নানান পরিস্থিতির সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকে।

happy wheels 2

Comments