উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় শ্যামনগরের ৫ আশ্রয়ন প্রকল্পের পুকুর পুনঃখননের উদ্যোগ
সাতক্ষীরা, শ্যামনগর থেকে গাজী আল ইমরান, বাবলু জোয়ারদার এবং বিশ্বজিৎ মন্ডল
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে সবচেয়ে হুমকির সন্মূখীন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল। প্রাকৃতিক দূর্যোগে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদী ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস এ অঞ্চলের নিত্যসঙ্গী। প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে উপকূলীয় এলাকার প্রতিবছর জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঘরছাড়া হতে হয় প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর অনেক মানুষকে। দূর্যোগ পরবর্তী সময়ে কতিপয় মানুষ বাস্তুভিটায় ফিরে গেলেও ফিরতে পারেনি অনেকে। তারা কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছে পাশ্ববর্তী গ্রামের খাস ভূমিতে, কাজের সন্ধানে কেউ চলে গেছে শহরে, কেউবা বাইরে। আবার কেউ আছে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সরকারি খাস জমিতে গড়ে ওঠা পূনর্বাসন কেন্দ্রে। প্রাকৃতিক দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বাস্তুভিটা বিচ্ছিন্ন প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর তেমনি দুটি আশ্রয়ন প্রকল্প পানখালী ও বুড়িগোয়ালিনী, যা ব্যারাক নামে পরিচতি। পানখালী আশ্রয়ন প্রকল্পের একটি এবং বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয়ন প্রকল্প ৪টিসহ মোট ৫টি পুকুর আছে। যে পুকুরগুলোর পানি আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর কৃষি উপযোগী এবং গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত হয়। সাথে প্রতিবছর বৈচিত্র্যময় মাছ চাষ করে পুকুর থেকে আয়ের একটি বড় অংশ আসে।
আশ্রয়ন প্রকল্পের পুকুরগুলো দীর্ঘদিন খনন না হওয়াতে পুকুরগুলো ভরাট হতে থাকে। গ্রীষ্মকালীন সময়ে পানি শুকিয়ে যায় ফলে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠরীর পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়। আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীরা পুকুরগুলো পুনঃখননের জন্য ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করলেও কোন সুফল হয়নি। কাজের সূত্র ধরে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর সাথে বারসিকও দীর্ঘদিন ধরে কাজ চলমান রেখেছে। সে লক্ষ্যে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠী পুকুরগুলো পুনঃখননের জন্য বারংবার বারসিক’র নিকট যোগাযোগ করে এবং তাদের সমস্যার কথাগুলো তুলে ধরেন।
বারসিক এর ধারাবাহিক কাজের অংশ হিসাবে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে তাদের চাহিদা অনুযায়ী এবং সমস্যার কথা বিবেচনা করে পুকুরগুলো পুনঃখননের জন্য উপজেলা প্রশাসনের সাথে ধারাবাহিকভাবে যোগাযোগ অব্যাহত রাখে। সাথে উপজেলা প্রশাসনকে নিয়ে আশ্রয়ন প্রকল্পগুলো পরিদর্শন করানো হয় এবং আশ্রয়ন জনগোষ্টীর সাথে মতবিনিময়ের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়। উপজেলা প্রশাসন আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে পুকুরগুলো পুনঃখনন করে দেওয়ার আশ^াস প্রদান করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় বুড়িগোয়ালিনী এবং পানখালী আশ্রয়ন প্রকল্পের পুকুরগুলো পুনঃখনন এর কাজ শুরু হয়। সেক্ষেত্রে পুকুরগুলো খননের জন্য যথাক্রমে পানখালী আশ্রয়ন প্রকল্পে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়, যা বারসিক’র সহায়তায় এবং আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে পানখালী পুকুর পুনঃখনন এবং পাড় সংস্কার এর কাজ সমাপ্ত হয়। একইভাবে বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয়ন প্রকল্পের ৪টি পুকুরের জন্য ৬৩ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়, যা দিয়ে পুকুর পুনঃখনন, বনায়ন, ঘাস রোপণ এবং সান বাধানো ঘাট তৈরি হবে। এ কাজগুলো চলমান রয়েছে।
পুকুর পুনঃখননের মাধ্যমে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠী নিজ নিজ বসত ঘরের সামনে উচু করে সবজি চাষের উপযোগি পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। সেক্ষেত্রে পুকুর পুনঃখনন ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর জীবনমান কি ধরনের পরিবর্তন হবে জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘পুকুর পুনঃ খনন হওয়া মানে আমাদের আয়ের পথ তৈরি হয়েছে। আমরা যেমন ১২ মাস সবজি চাষ করতে পারবো, মাছ চাষ করতে পারবো, গৃহস্থালির কাজ করতে পারবো, নানান ধরনের ফলজ গাছ লাগাতে পারবো। আমাদের পারিবারিক খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তেমনিভাবে সবজি, মাছ ও ফল বিক্রির মাধ্যমে পারিবারিক উন্নয়নের সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।’
আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা উন্নয়নের ক্ষেত্রে আশ্রয়ন প্রকল্পের পুকুর একটি বড় ভূমিকা রাখে। তাই আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর উদ্যোগ সহযোগিতা আশ্রয়ন প্রকল্পকে প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ করে তুলতে সাহায্য করেছে, নিরাপত্তা দিতে চেষ্টা করেছে আশ্রয়ন জনগোষ্ঠীর পরিবারের খাদ্য চাহিদা। বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ, কৃষিচর্চা ও স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রা পরিচালনার একটি বাস্তব উদাহরণ হতে পারে আশ্রয়ন প্রকল্প।