কোথায় গেল আমাদের বৈচিত্র্যময় খাদ্য?
রাজশাহী থেকে অমৃত কুমার সরকার
ক্রিসটিনা টুডু আর রানী হাসদা মন দিয়ে সুঁইয়ের সহযোগিতায় নিয়ে ছোট ছোট শামুক থেকে মাংস বের করছে। দুজনেরই বয়স ৬৫ বছরের একটু বেশি। দুজনেরই বসবাস রাজশাহীর তানোর উপজেলার মন্ডুমালা মাহালী পাড়া এলাকায়। তাঁরা এই বয়সে জমিতে কাজ করে ফেরার পথে মাঠের একটি ছোট পুকুর থেকে কিছু ছোট জাতের শামুক তুলে এনেছেন। তা দিয়েই দুদিন পরিবারে রান্না করে দিবেন। রানী হাসদা বলেন, ‘এখন তো ছোট শামুকই পাওয়া যায় না! বড় শামুক আর তেমন আমরা দেখতেই পাই না। বিল দিয়ে সব মেরে ফেলেছে। আবার পুকুরে পানিও থাকে না আগের মতো।’ ক্রিসটিনা টুডু বলেন, ‘আগে আমরা শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া,কুঁইচা অনেক কিছু পেতাম। কোথায় গেল সেই দিন?’
রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলে অনেক আদিবাসীর বসবাস। এই অঞ্চলে প্রায় ৪৫টি জাতি সত্ত্বার বসবাস। এখানে যেমন অনেক জাতি সত্ত্বার বৈচিত্র্য আছে ঠিক আছে তাঁদের খাদ্য ও সংষ্কৃতির বৈচিত্র্য। আদিকাল থেকেই আদিবাসীরা নিজেদের জীবন ধারনের অন্যতম পথ হিসেবে প্রকৃতিকে বেছে নিয়েছেন। প্রকৃতি থেকেই তাঁরা তাঁদের দৈনন্দিন খাদ্যের চাহিদা মিটিয়েছেন। তাঁরা প্রকৃতিকে ঠিক এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যাতে তাঁরা খাবারও পান আবার প্রকৃতির ভারসাম্যও বজায় থাকে। আদিবাসীরা বন থেকে বন আলু, মাসরুম, বন কচু সংগ্রহ করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে ছোট মাছ, কাঁকড়া শামুক, ঝিনুক সংগ্রহ করতেন খাবার হিসেবে। আবার এই সংগ্রহ বন্ধ থাকত বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে যখন উক্ত খাদ্যগুলো জন্মানোর মৌসুম। খাবারগুলো সংগ্রহ করা নিজেদের একটি ধরণ ছিলো।
নানা কারণে দিন এখন পরিবর্তন হয়েছে। এখন ঠিক মতো বৃষ্টি হয় না। তাপ বেড়েছে অনেক। সাথে বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার। বেড়েছে ভূমিদস্যূদের দৌড়াত্মও। খাস ও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো চলে গেছে দখলদারদের হাতে। আবার পুকুরগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে শুধু মাছ চাষ এবং রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে আর সেখানে শামুক, ঝিনুক জন্মাতে পারে না। আবার বিভিন্ন কারণে অকারণে সেই পুকুরগুলোতেও নামতে দেওয় হয় না আদিবাসীদের। অন্যদিকে আবহাওয়া ও জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের সময় পরিবর্তন হওয়ায় এ অঞ্চলের খাল, খাড়িতে ঠিক মতো পানি থাকে না। যার ফলে সেখানেও তেমন জন্মায় না আদিবাসীদের জলজ খাবারগুলো। এছাড়া কৃষিজমির মাত্রাহীন ব্যবহৃত কীটনাশকগুলো খাল, খাড়িতে মিশে দেশি মাছের বৈচিত্র্যর বিলুপ্ত ঘটাচ্ছে। সাথে হারিয়ে যাচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় খাবার ও এ খাবার কেন্দ্রিক তাঁদের নানা সংষ্কৃতি। ফলে আদিবাসীরা ভূগছে পুষ্টিহীনতায়। তাই এই অঞ্চলের আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় খাদ্যর ফিরিয়ে দিতে প্রয়োজন স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন প্রক্রিয়া এবং সমন্বিত উদ্যোগ।