পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কল্পনা ও অর্চনা রাণীর উদ্যোগ

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

প্রতিটি প্রাণের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন খাদ্য। খাদ্য ছাড়া কোন প্রাণ বেঁচে থাকতে পারে না। আমাদের মনুষ্য জাতির অর্থাৎ মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হচ্ছে খাদ্য। খাদ্য উৎপাদনের সাথে কৃষক বিভিন্নভাবে যুক্ত, বড় এলাকায় খাদ্য উৎপাদন, মাঝারি এলাকায় খাদ্য উৎপাদন ও ক্ষুদ্র এলাকায় খাদ্য উৎপাদন। আর এ খাদ্য উৎপাদনের জন্য অন্যতম জায়গা হচ্ছে বসতবাড়ির আঙিনা। বসতবাড়িতে সবজি উৎপাদন করে না এমন কৃষাণ-কৃষাণী খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুরূহ। আমাদের দেশে খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে নারীরা নিবিড়ভাবে জড়িত। এভাবে বসতবাড়ির  খাদ্য উৎপাদন করে খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রেখে চলেছেন শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের দুই নারী কল্পনা রাণী (৪৮ ও )অর্চনা রাণী (৪০)।

পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এই দুই গ্রামীণ নারী তাদের সক্ষমতা ও জ্ঞান যথার্থভাবে ব্যবহার করেছেন, যা অন্যান্য নারীদের জন্য অনুপ্রেরণামূলক। কল্পনা রাণী ও অর্চনা রাণী তাদের পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য  বসতভিটায় সবজি তথা মিষ্টি কুমড়া, বেগুন, লাউ, ঝিঙা, তরুল, চালকুমড়া, শসা, পাতাকপি, উচ্ছে, খিরাই, কচুরমুখী, বরবটি, আলু, ওলকপি, ঢেড়স, ওল, লাল শাক, মূলা, গাজর, পুইশাক, কলা,পেপে, চুবড়ি আলু, পালনশাক, বীটকপি, ডাটাশাক, কচু, কলা, পেঁপে, ঝাল,  টমেটো, কচু, লাউ). মসলা ( মৌরি, ধনে, পেয়াজ, রসুন, হলুদ, আদা, জিরা, এলাচ), ডাল (কলুই), তেল ( সরিষা) জাতীয়  ফসল চাষ করেন।

sat
শাকসবজি ছাড়াও তাঁদের বসতভিটায় ফল যেমন আম, জাম, কাঁঠাল, বাতাবিলেবু, জামরুল, লিচু, তাল, খেজুর, কলা, ছবেদা, নারকেল, সুপারি, পাতিলেবু, কাগচিলেবু, পেপে, শাক আলু, আমড়া, পান, পেয়ারা, কুল, সজিনা, আনারস, বেল, ডুমুর, গাব গাছ রয়েছে। পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য প্রকৃতিতে আপন মনে জন্মানো অচাষকৃত উদ্ভিদ তথা থানকুনি, হেলাঞ্চ, বৌনুটি, আদাবরুণ, আমরুল, তেলাকচু, কাটানুটে, সেঞ্চী, নোনাশাক, কাথাশাক, গিমেশাক, দুধ সেঞ্চি, দূর্বা, তুলসি, কলমিশাক ইত্যাদি উদ্ভিদগুলোকে তারা পরম মমতায় যতœ করছেন, পরিচর্যা করছেন এবং সংরক্ষণ করছেন।

শুধু শাকসবজি, বা ফল খেলে মানুষের পুষ্টি প্রাপ্তি সম্পন্ন হয় না; প্রয়োজন প্রাণীজ আমিষও। অর্চনা রাণীরা তাই পুকুরে মাছ চাষ করেন। তাদের চাষকৃত মাছের মধ্যে রয়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার, টেংরা, পুটি, ট্যাবলেট, শোল, কই, তোড়া, মরুল্য, কাঁকড়া, চিংড়ি, তেলাপিয়া, বাইন, মাগুর ইত্যাদি। গৃহপালিত পশু-প্রাণীর মধ্যে রয়েছে মুরগি, গরু ও ছাগলও। এ প্রসঙ্গে কল্পনা রাণী ও অর্চনা রাণী জানান, তাদের দুই পরিবারে শুধুমাত্র  লবণ ও কেরোসিন এবং মাঝে মধ্যে সয়াবিন তেল কিনতে হয়। তাছাড়া বছরে সংসারের চাহিদা মিটিয়ে সবজি  বিক্রি করেন, যা তাদেরকে বাড়তি আয় নিশ্চিত করে। এসব ফসল বিক্রির জন্য তাদের কোন সময় বাজারে যেতে হয় না; বাড়ি থেকে পাইকারী ও খুচরা বিক্রি করতে পারেন। কারণ তাদের উৎপাদিত পণ্যগুলো বিষমুক্ত। উৎপাদিত ফসলাদি তারা পরস্পরের সাথেও সহভাগিতা করেন বলে তাঁরা জানান।
কল্পনা রাণী ও অর্চনা রাণী ফসল চাষ করে তাদের পতিত বসতভিটা যেমন সদ্ব্যবহার করেছেন, পরিবারের জন্য বিষমুক্ত খাদ্যের যোগান  ও সংস্থান করেছেন।

এছাড়া জৈব উপায়ে এসব ফসল আবাদ করায় তিনি পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। পাড়াপ্রতিবেশীর মাঝেও এসব শাকসবজি বিতরণ করে একদিকে যেমন তাদের সাথে স্যেহার্দ্য সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটাতে ভূমিকা রেখেছেন তেমনিভাবে ফসল বিক্রি করে পারিবারিক অথনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখেছেন। নিজেদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং পরিবারের জন্য পুষ্টিকর ও ভেজালহীন খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য কল্পনা ও অর্চনা রানীর মতো বাংলাদেশে অনেক নারী রয়েছেন যারা দিনরাত পরিশ্রম করেন। গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি তারা এসব কাজ করে থাকেন। অথচ তাদের এ কাজের কোন স্বীকৃতি নেই! নারীরা খাদ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত থাকলেও তাদের এ কাজের সাফল্যে পুরুষেরা ভাগ বসায়। স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চা করে নারীরা পরিবেশকে ভারসাম্য রাখতে অবদান রাখে এবং পারিবারিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। তাদের কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে।

পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তাসহ কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর টেকসই জীবন জীবিকা পূনঃগঠনে কল্পনা রাণী ও অর্চনা রাণীর এ উদ্যোগ উপকূলীয় অঞ্চলসহ বাংলাদেশের যে কোন গ্রামীণ নারীকে অনুপ্রাণিত করবে, উৎসাহ, সাহস ও শক্তি জোগাতে ভূমিকা রাখতে পারে।

happy wheels 2