মানবিক পাঠশালা
চট্টগ্রাম খেকে তরুণ বিশ্বাস
দিনটি ছিলো ৯ নভেম্বর ২০১১ । জনপ্রিয় হবার ঠিক মাঝামাঝি পর্যায়ের ফেইজবুক নামক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি গ্রুপ থেকেই চট্টগ্রামে কিছু তরুণের হাত ধরে জন্ম নিল “মানবিক” নামক অরাজনৈতিক ও অলাভজনক একটি সামাজিক সংগঠনের । জন্মলগ্ন থেকেই মানবিকের উদ্দেশ্য ছিলো এদেশের সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে থাকার । প্রথমাবস্থায় শীতবস্ত্র বিতরণের মতন সমাজ সেবামূলক কিছু কাজ করে। পরবর্তীতে, সমাজে যেসব সমস্যা দেখা সেগুলোর মূল কারণ জানার চেষ্টা করে সংগঠনের সদস্যরা। তারা মনে করেন, সসমস্যাগুলোর মূলক কারণ উন্মোচিত না হলে প্রকৃত সমাধান আসবে না।সমস্যা মূল কারণ উৎঘাটন করতে গিয়ে সংগঠনের সদস্যরা তাদের দেখতে পেলেন শিক্ষার অভাবের কারণে সমাজে নানান সমস্যা দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো প্রজ্বলনের লক্ষ্য নিয়ে তিনটি অবৈতনিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্কুলগুলোর নামকরণ তারা করেছে ‘মানবিক পাঠশালা’। এভাবে কাট্টলি জেলে পাড়ায় মানবিক পাঠলালা ইউনিট-১ রয়েছে, ইউনিট-২ রয়েছে শুলকবহর, মুরাদপুরে এবং ইউনিট-৩ রয়েছে চাদগা আবাসিক এলাকায় । তিনটি স্কুলে প্রায় ১৫০ পথশিশু/ছিন্নমূল সুবিধাবঞ্চিত শিশু বিনামূল্যে পড়ানো হয় । মানবিক সদস্যদের নিয়ে প্রতি মাসেই একটি মিটিং আয়োজন করা হয়, যা “মানবিক আড্ডা” নামে পরিচিত ।
মানবিক পাঠশালা তিনটির সঠিক পরিচালনার জন্য মানবিকের প্রায় ৫০ জন সদস্যের স্বেচ্ছাশ্রম ভি্ত্তিতে কাজ করছেন। এছাড়া সদস্যদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা আদায় করা হয় এ স্কুল পরিচালনার জন্য। শিক্ষার্থী সদস্যদের কাছ থেকে মাসিক ৫০ টাকা এবং চাকুরিজীবী সদস্যদের কাছ থেকে মাসিক ১০০ করে একটি তহবিল তারা গঠন করেছে। এই তহবিলের মাধ্যমে স্কুলগুলোর যাবতীয় খরচ করা হয়।
এই সংগঠনের মাধ্যমে শুধু শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় না; বরং প্রতিমাসে একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয় সচেতনতা তৈরির জন্য কিংবা সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে বিভিন্ন সেবা দেওয়ার জন্য। উদাহরণস্বরূপ গত রোজার ঈদে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় পাঁচ শতাধিক পথশিশুকে একত্র করে ঈদের নতুন জামা-কাপড় দেওয়া হয়। আসন্ন পুজার উপলক্ষে এরকমই একটি উদ্যোগ নেওেয়ার পরিকল্পনা করেছে সংগঠনের সদস্যরা।
অন্যদিকে দুঃসময়ে রক্ত প্রার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য মানবিকের অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ব্ল্যাড ডোনেট গ্রুপ রয়েছে । এছাড়া মানবিক পাঠশালায় সব শিক্ষার্থীদের আদব-কায়দা শেখানো হয়, চারিত্রিক গঠনের বিভিন্ন গুণাবলী শেখানো হয়। শুধু তাই নয়, শিশুরা যাতে বিনোদন করতে পারে, আনন্দ করতে পারে অন্য শিশুদের মতোই সেজ্ন্য তাদের খেলার সামগ্রী ও খেলনা দেওয়া হয়। এসব শিক্ষা ও খেলার উপকরণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে এলাকার সম্মানিত ব্যক্তি নানাভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন মানবিকের প্রতি বলে সদস্যরা জানান। মানবিক সদস্যরা মানবিকের তিনটি পাঠশালায় অধ্যয়নরত দরিদ্র শিশুদের নিয়মিত খোঁজ খবর রাখেন ।
এসব সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করেছেন মানবিকের সদস্যরা। তারা তাদের কোরবানীকৃত গরুর মাংস বঞ্চিত শিশুদের সাথে ভাগাভাগি করার জন্য গত ২৩ সেপ্টেম্বর একটি ‘ঈদ আনন্দ’ উৎসব আয়োজন করে । এই ‘ঈদ আনন্দ উৎসবে মানবিক পাঠশালার প্রায় ১৫০ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশু অংশ নেয়। এই আনন্দ-এর অংশ হতে পেরে শিশুরা খুবই আনন্দিত। এই প্রসঙ্গে মানবিক-এর এক সদস্য বলেন, “ঈদ উৎসবে শিশুদের চোখে মুখে যে খুশির ছায়া দেখতে পাই, তাতে আমরা সত্যিই আবেগে আপ্লুত হয়েছি। তাদের ভেতরে আনন্দ দিতে পারছি-এটা ভাবতেই অসম্ভব একটা ভালোলাগা অনুভব করি। আমি মনে করি এটাই আমাদের সফলতা।”
দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যখন তরুণ ও ইন্টারনেটকে সর্বাধিক খারাপ দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে ঠিক তখন এই তরুণ সমাজের একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগা মাধ্যমকে হাতিয়ার করেই ইচ্ছেশক্তিতে ভর করে পাল্টাতে চেষ্টা করছে বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত অবহেলিত ঐ অংশটিকে । তাদের হাত ধরেই হয়তো এই তরুণরা একদিন সফলতা শিখরে পৌছাবে। শিক্ষা ও মানবিক গুণাবলীতে সজ্জিত হয়ে এই বঞ্চিত শিশুরাই দেশের নেতৃত্ব ভার নেবে, সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের দূত হয়ে দূর করবে সব ধরনের পঙ্কিলতা, দূরীভূত করবে অন্ধকার। এতেই স্বার্থক হবে তরুণদের এই অভিনব ও দায়িত্বশীল উদ্যোগ। তরুণরা যে, ইতিবাচক পরিবর্তনের দূত হতে পারে চট্টগ্রামের এই তরুণরা সেটা প্রমাণ করেছেন। তাদের এই উদ্যোগ অন্য এলাকার তরুণদের অনুপ্রাণীত করুক-এ কামনা করি।