কার কতখানি কৃষি জমি থাকবে?
পাভেল পার্থ
জনপ্রিয় সার্চইঞ্জিন গোগলে ‘কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ’ দিয়ে সার্চ দিলে সরকারের তথ্য বাতায়ন হাজির হয়ে যায়। তথ্যবাতায়ন লিখেছে, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এছাড়াও জানিয়েছে, এদেশে শতকরা ৭৫ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। গ্রাম এলাকায় ৫৯.৮৪% এবং শহরের ১০.৮১% লোকের কৃষিখামার আছে। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১৯.১% এবং এ খাতের মাধ্যমে ৪৮.১% মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। কৃষিকাজের ভিত্তি হলো জমি। আর এই জমি দিনে দিনে খুন হচ্ছে। কৃষিজমির লাশের উপর লাগাতার গড়ে তোলা হচ্ছে কারখানা, দালান, সড়ক, বাণিজ্যিক খামার ও সেতু। কৃষি জমি সুরক্ষার প্রশ্নে ২০১৫ সনে তৈরি হয়েছে ‘কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন’। নিদারুণভাবে আইনটি এখনো খসড়া হয়ে পড়ে আছে, একে চূড়ান্ত করে কার্যকর করবার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না রাষ্ট্র। তবে চূড়ান্তকরণের আগে একটা বিষয় ফায়সালা হওয়া জরুরি যে, কতটুকু কৃষিজমি এক একটি পরিবারের থাকবে। মানে একজন বা একটি পরিবার সর্বোচ্চ কতখানি কৃষিজমির মালিক হতে পারবে। পরিবারভিত্তিক কৃষিজমির এই সীমানা পরিমাণ নির্ধারণ জরুরি। কারণ তা না হলে কৃষিজমির দখল, গুম ও নিখোঁজ থামানো যাবে না। দেশে এক এক অঞ্চলে কৃষিজমির বিন্যাস, বন্টন ও মালিকানা এক এক রকম। উত্তরাঞ্চলে দেখা যায় গুটিকয় সামন্ত পরিবার বিশাল সব কৃষিজমির একক মালিক। তাদের জমিনেই বর্গা খাটে বাদবাকী গ্রামের সব মানুষ। হাওরাঞ্চলে দেখা যায় কোনো পরিবারের দিগন্ত বিস্তৃত বোরো ধানের জমিন আবার কারো শুধু বিছরা ক্ষেত।
২.
কৃষিজমির মালিকানা ও বণ্টনের একটা সুষম রীতি এখনও পর্যন্ত অমীমাংসিত। ১৭৬৫ সনে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা বিহার ওড়িশা তথা ‘সুবে বাংলার’ দেওয়ানী অধিকার অর্জন করল। তারপর থেকেই রাজস্ব আদায় ও বৃদ্ধির ওপর কোম্পানির শাসকেরা জোর দিল। তাদের বাণিজ্যের প্রয়োজনীয় পুঁজি হিসাবে সংগৃহীত রাজস্বকে কাজে লাগানোর দিকেই তাদের ঝোঁক ছিল। ভূমি রাজস্বই ছিল তখন সরকারি আয়ের প্রধান উৎস। এজন্য ভূমি ব্যবস্থায় দশশালা বা পাঁচশালা বন্দোবস্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষে লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৯৩ সনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। আবহমানকাল থেকে কৃষকেরাই জমির প্রকৃত মালিক ছিল, কৃষকেরা তাদের চিরকালের এই অধিকার হারাল। জমির সামাজিক বা গোষ্ঠী মালিকানা বিলুপ্ত হল। জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা কায়েম হল, জমি পণ্যে পরিণত হল। এতকাল উৎপন্ন ফসলের একটা অংশ রাজস্ব হিসেবে জমিদার বা রাজাদের দেবার যে ব্যবস্থা চিল তা লোপ পেল। নগদ বা মুদ্রায় খাজনা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হল। জমি পণ্য হিসেবে গণ্য হবার ফলে তা কেনাবেচার সামগ্রী হিসেবেও গণ্য হল। আর ভূমির উপর রাষ্ট্র একতরফা নিয়ন্ত্রণ ও বিধান জারি করার ভেতর দিয়ে ভূমির সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রতিবেশগত বৈশিষ্ট্য ও অধিকারকে অস্বীকার করল। সামাজিক কৃষিজমি হয়ে ওঠলো ব্যক্তিমালিকানার ভূমি। বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবারের সংখ্যা বাড়লো, অনেক আদিবাসী সমাজে গোত্রভিত্তিক জমিগুলো পারিবারিক হয়ে পড়লো। একটি বড় জমি বাস্তুসংস্থানও টুকরো টুকরো হয়ে পড়লো। আইলবিহীন বিস্তীর্ণ জমিগুলো নানান মাপের আইলে আবদ্ধ হয়ে গেল। একটা বড় কৃষিমাঠ জমিনে কার টুকরায় কে কি বুনবে না বেচবে তা মূলত: একটি একক পরিবারের সিদ্ধান্তের বিষয় হয়ে দাঁড়াল। এতে দেখা গেল, পরিবারের নারীদের কৃষিজমির সিদ্ধান্ত থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হলো এবং জমি ব্যবহার হয়ে ওঠলো পরিবারের পুরুষপ্রধানের একমাত্র এখতিয়ার। যেসব আদিবাসী সমাজে বংশগত গোত্রজমির চল ছিল তাও একটা সময় একেবারেই ব্যক্তিগত জমিতে পরিণত হতে বাধ্য হল। যেমন মাতৃসূত্রীয় মান্দি আদিবাসীদের আখিম জমি, যা তাদের গোত্র অনুযায়ী বংশ পরম্পরায় বাহিত ও ব্যবহৃত হয়।
৩.
দেশে একটি পরিবারে কতটুকু কৃষিজমি থাকবে তা রাষ্ট্র নানাসময়ে নানাভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় জড়িত হয়েছে রাজনৈতিক দেনদরবার ও ক্ষমতার স্বার্থ। কখনোই কৃষিজমির সুরক্ষা বা কৃষকের অধিকার নয়। খাস জমির বণ্টন শীর্ষক আবুল বারকাত ও অন্যান্যদের (২০০০) একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৫০ সনে যখন রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন কার্যকর হয় তখন প্রতি পরিবারের জন্য ৩৩.৩ একর (১০০ বিঘা) কৃষি জমি নির্ধারিত হয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সনে আইয়ুব খান সরকার ধার্য করে ১২৫ একর (৩৭৫ বিঘা), দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সনে আবারো ধার্য হয় ৩৩.৩ একর, ১৯৮২ সনে ভূমি কমিশন প্রস্তাব করে ২০ একর (৬০ বিঘা)। ১৯৮৭ সালের ভূমি সংস্কার আইনে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘ভূমিহীনের’ বৈশিষ্ট্য পরিচয় তৈরি করা হয়েছে। উক্ত আইনে বলা হয়েছে, সেই পরিবার ভূমিহীন যে পরিবারের বসতবাটি এবং কৃষিজমি কিছ্ুুই নাই, কিন্তু পরিবারটি কৃষি নির্ভর। যে পরিবারের বসতবাটি আছে কিন্তু কৃষি জমি নেই অথচ কৃষিনির্ভর। যে পরিবারের বসতবাটি এবং কৃষি জমি উভয়ই আছে কিন্তু তার মোট পরিমাণ ০.৫০ একরের কম অথচ কৃষিনির্ভর তারাই ভূমিহীন।
রাষ্ট্রীয় আইনের ভাষ্য ও নথিমতে, দেশের অধিকাংশ আদিবাসী পরিবারই আজ ভূমিহীন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত এদেশে আদিবাসীদের মধ্যে ভূমিহীনের সংখ্যা ছিল শতকরা ২০-২৫ ভাগ, যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৯০ ভাগে। সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে এই ভূমিহীনতার কাহিনী বেশি তীব্র ও করুণ। ব্যক্তিগত মালিকানার পাশপাশি কৃষিজমির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মালিকানার আইনগত স্বীকৃতি দিতে হবে। আদিবাসী জনগণের কৃষি ও জুম জমির প্রথাগত অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। ঝিনাইদহ ও কক্সবাজারে কিছু মানুষ দশে মিলে নিজেদের কৃষিজমিকে একত্র করে যৌথখামার গড়ে চাষাবাদ করছেন। দেশজুড়ে এমন যৌথ কৃষি উদ্যোগকে গুরুত্ব দিয়ে কৃষিজমি সুরক্ষায় যৌথকৃষি খামারকে অগ্রাধিকার দেয়ার বিধান রাখতে হবে। শ্রেণি, বর্গ, সংস্কৃতি ও অঞ্চল ভিন্নতাকে গুরুত্ব দিয়ে কৃষি জমির সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ মালিকানার সীমানা কৃষিজমি সুরক্ষা আইনে উল্লেখ করতে হবে।
৪.
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের আরেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো খাস জমি বণ্টন। খাসজমি বণ্টনের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র ভূমি সংস্কারের যে উদ্যোগ চালু রাখে তা সামাজিক অসমতার সাথে জড়িত। কারণ রাষ্ট্রে কিছু মানুষের জমিজমা নেই বলেই রাষ্ট্র ভূমিহীনদের মাঝে ‘খাসজমি বণ্টনকে’ একটা দায়িত্ব হিসেবে দেখে। কৃষিজমি সুরক্ষা আইনের ৪ (১) নং ধারায় বলা হয়েছে, দেশের সকল খাসজমি কেবল ভূমিহীনরা পাইবার এবং ভোগ দখলে রাখিবার অধিকারী হইবেন। তবে খাস কৃষিজমি কৃষিকাজ ব্যতীত অন্যকোন কাজে ব্যবহার করা যাইবে না। তবে ভূমিহীন ব্যতীত কৃষি খাস জমি অন্য কাউকে বন্দোবস্ত দেওয়া হইয়া থাকিলে উহা বাতিল করিতে হইবে।’ নিঃসন্দেহে বিধানটি গুরুত্ববহ, কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? খাসজমি মূলত কারা দখল ও লুন্ঠন করে? আন্তর্জাতিক ভূমি সংহতি (২০১০) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বাজার আগ্রাসন এবং বৈষম্যমূলক নীতি দুনীর্তিগ্রস্ত প্রভাবশালীদের ভূমিগ্রাসকে টিকিয়ে রাখে। এই ভূমিগ্রাস সচল থাকায় মানুষ গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে ক্রমাগতভাবে শহরে চলে আসে এবং কৃষিজীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দেখা যায়, এসব খাস জমি গরিব ভূমিহীন নয়, জবরদখল করেন প্রভাবশালীরা। কেবল ভূমি হ্রাস বা ক্ষয় নয়, প্রতিবছর দেশে এক নির্দিষ্ট পরিমাণ ভূমিও জেগে ওঠছে। দেখা যায়, দেশের দক্ষিণ উপকূলে নতুনভাবে জেগেছে ৯০,৫১২ হেক্টর ভূমি। দেশে প্রতিবছর ২০ বর্গ কি.মি. ভূমি বাড়ছে। এমনকি একসময়ের ছিটমহল বর্তমান বাংলাদেশের অংশ যেখানে রয়েছে কৃষিজমি। এই যে প্রতিবছর নতুনভাবে জেগে ওঠা কৃষিজমি তার বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আইনে কোনো ধরণের বিধান নেই। নদী ও সমুদ্র থেকে জেগে ওঠা নতুন ভূমির মালিকানা বেশ জটিল। দেশে নতুন জেগে ওঠা চর দখল ও মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাত বেশ পুরনো। এ নিয়ে সংঘর্ষ কী রক্তপাত নতুন কোনো ঘটনা নয়। প্রতিনিয়ত জেগে ওঠা নতুন ভূভাগ কীভাবে কৃষিকাজে ব্যবহৃত হবে, তার মালিকানা ও বণ্টন বিষয়ে কৃষিজমি সুরক্ষা আইনে সুস্পষ্ট বিধান রাখা জরুরি। যদিও কৃষি ও জুমের সূচনা নারীর হাতেই কিন্তু আজ বাজারনির্ভর কর্পোরেট কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত কৃষির বলপ্রয়োগে নারীর কৃষি ও কৃষিতে নারীর অধিকারকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। উৎপাদনের সাথে নিরন্তর যুক্ত থেকেও সকল সমাজেই নারী সম্পত্তির মালিকানা, উত্তরাধিকার, নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতায়নের রাজনৈতিকতা থেকে উৎখাত। এটি পিতৃসূত্রীয় কি মাতৃসূত্রীয় সকল পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্বেই প্রবল। কৃষিজমি সুরক্ষা আইনে নারীর কৃষিজমি অধিকার বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। কৃষিজমির মালিকানা নিয়ে আইনগত সিদ্ধান্তে অবশ্যই নারীর কৃষিজমির মালিকানার অধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে বিধান তৈরি করতে হবে। কার কতখানি কৃষিজমি থাকতে পারে এই মৌলিক প্রশ্নের ভেতরেই লুকিয়ে আছে শ্রেণি, বর্গ ও সমাজের বিভেদ ও বৈষম্যের ব্যাকরণ। আজ লুন্ঠিত ও বিপদাপন্ন কৃষিজমি সুরক্ষায় বৈষম্যের এমন সব ব্যাকরণ চুরমার করেই দাঁড়াতে হবে। পরিবারভিত্তিক কৃষিজমির সিলিং চূড়ান্ত করে কৃষিজমি সুরক্ষায় দ্রুত কার্যকর হোক কৃষিজমি সুরক্ষা আইন।
……………………………………………………………….
গবেষক ও লেখক। [email protected]