নতুন পরিবেশ নতুন চ্যালেঞ্জ
কলমাকান্দা উপজেলার সদর ইউনিয়নের নাগঢড়া গ্রামের বড় হাওর পাড়ের একাংশে বিগত বছরের প্রায় অক্টোবর মাস থেকে নতুনভাবে বসতি গড়েছেন কৃষক মোহাম্মদ খোরশেদ মিয়া (৪৬)। তার বাড়ির ২-৩ কিঃ মিঃ এর মধ্যে কোন বাড়ি ঘর নেই, গাছপালা নেই, পাখির কলকাকলীও নেই। সারাদিন মানুষের যাতায়াতের কারণে লোকারণ্য থাকলেও সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে শুরু হয় নির্জনতা। ঘরে শুধুমাত্র তার স্ত্রী ও এক মেয়ে আছে। এবছরের বর্ষাকালটা হবে তার জন্য টিকে থাকার এক নতুন চ্যালেঞ্জ। এখন টিকে থাকার তেমন কষ্ট না থাকলেও বর্ষাকালে প্রায় ৬-৮ ফিট পানির উচ্চতা ও আফালের (বন্যার ঢেউ) প্রচন্ড আঘাত সহ্য করতে হবে তাকে। তার এই দীর্ঘ জীবনের পথচলায় নানান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেও আফালের আঘাত প্রতিহত করার অভিজ্ঞতা নেই তার। তাই এবছরের বর্ষাকালে আফাল দূর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য এখন থেকেই তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন ধীরে ধীরে। পাশাপাশি জীবিকার জন্যও নতুন নতুন পথ খুঁজে বের করতে হচ্ছে তাকে। এরূপ পরিবেশ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য কি কি কৌশল অবলম্বন করছেন তা জানার কৌতুহল থেকেই কথা হয় তার সাথে। তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নেত্রকোনার অর্পণা ঘাগ্রা।
বারসিকনিউজ: হাওরের মাঝে প্রতিবেশীহীন নির্জন জায়গায় বাস করছেন কেন?
খোরশেদ মিয়া: আমি একজন ভূমিহীন। নিজের কোন জমি জমা নেই। তাই ২০০১ সাল থেকে খাস জমিটা বন্দোবস্ত কইরা আনার জন্য দরখাস্ত দিয়া রাখছিলাম। অনেকদিন এই অফিস সেই অফিস ঘুরতে ঘুরতে দুই বছর আগে জমিটা পাইলাম। জমিটা পাওয়ার পরও অনেকজনের কাছ থেকে অনেক বাধা আইছে। এখনও অনেকে বাধা দেয়। কিন্তু আমি এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বাস করতে চায়। অনেক কষ্ট করে পাওয়া এই জায়গা। ভালো হউক মন্দ হউক মরলেও এইখানেই মরমু বাঁচলেও এইখানেই বাচমু।
বারসিকনিউজ: এইখানে বসবাস করার শুরুর দিকটা জানতে পারি?
খোরশেদ মিয়াঃ মানুষের বাইচা থাকার জন্য পানির দরকার। তাই প্রথমেই আমি টিউবওয়েল বসাইছি। তাই পানির সমস্যা হয় না। আর মাটি যেহেতু এখনও ঠিকমত বসে নাই তাই কম খরচে কোন রকমে ঘর বানাইলাম। এইখানে আমার ১২ কাঠা জমি। তার মধ্যে ২ শতাংশ জায়গায় ঘর বানাইলাম। বাকি জায়গাগুলাতে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, পুইশাক, খিরা, টমেটো, লাল শাক, ঢেড়শ চাষ করলাম। শাক সবজি বিক্রি কইরা সংসার চালাইতেছি। শাকসবজি থেকে আয় না হওয়া পর্যন্ত চা, পান, বিস্কিট কিছু কিছু বিক্রি করলাম। সারাদিন কোন না কোন মানুষ দোকানে বইসা থাকে। অনেকে আমার সবজির বাগান ঘুইরা দেখে। আমারে উৎসাহ দেয়। আমার সবজি চাষ করা দেইখা প্রথমে সব মানুষ মানা করছিলো। কিন্তু আমি তাদের কথা শুনি নাই। আর এখন এই সবজিই আমাদের বাচাঁইতেছে।
বারসিকনিউজ: অন্য কিছু না হয়ে কেন সবজি চাষ করার উদ্যোগ নিলেন?
খোরশেদ মিয়া: সবজি চাষ করার কাজটা আমি ভালো জানি। আমি যখন বাড়ি ছাইড়া ঢাকা শহরে যায় তখন রাজমিস্ট্রির সাথে যোগালের কাজ করছি। কয়েক বছর এই কাজ করার পর পান সিগারেট বিক্রি করলাম। এই সময় দীর্ঘদিন জার্মানে ছিল এমন একজন লোকের সাথে পরিচয় হয়। তিনি আমারে তার বাড়িতে চাষ করা স্ট্রবেরির বাগানে কাজ করার সুযোগ দেয়। তার বাড়িতে অনেক বড় বড় অফিসাররা আসতো। পরে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমারে কাজ দেয়। সেখানেই আমি স্ট্রবেরীসহ অনেক শাক সবজি চাষ করা শিখছি প্রায় ৬ বছর ধইরা। হেই থেকেই মনের মধ্যে ইচ্ছা ছিল যদি আমার কোন সময় জায়গা হয় তাহলে সবজি চাষ করমু। এখন আমি আমার ইচ্ছা পূরণ করতে পারতাছি। এখনও সবজিগুলো বিক্রির উপযুক্ত হয় নাই। তবে প্রতিদিন আমি শাক ও খিরা বিক্রি কইরা ৫০০-৬০০ টাকা আয় করি। এইটা দিয়াই কোন রকমে দিন চইল্যা যায়।
বারসিকনিউজ:কোন পদ্ধতিতে শাক সবজি চাষ করছেন এবং কেমন সফলতা আশা করছেন ?
খোরশেদ মিয়াঃ বীজ বোনার আগেই মাটি গর্ত কইরা প্রত্যেকটা গর্তে ৪ কেজি করে গোবর দিছি। আমার নিজের গরু নাই। কিন্তু যার কাছ থেকে আমি গোবর আনি তার দুইটা গরু। তারে আমি মাসে তিনশো টাকা দিই। সে গোবর জমাইয়া বস্তায় ভইরা রাখে। শুধু তার গোবরেই হয় না। আরো অন্য জনের কাছ থেকেও কিইন্যা আনতে হয়। এই জায়গায় কয়েক মাস ধইরা হাঁসের খামার থাকে। হাঁসের বিষ্ঠাগুলা নিয়া আইসা মাটির সাথে মিশাইয়া সার বানাই। পানি দিই ঘরের সামনে যে নাগঢড়া খাল আছে এখান থেইকা। এখন পর্যন্ত এই খালে পানি আছে। আরো কয়েক মাস থাকবো মনে হয়। এর পানি দিয়াই সবজি চাষ করতাছি। প্রত্যেকদিন পানি দিতে হয়না। বাগানের সাইডে আমি ড্রেন খুরসি। এই ড্রেনে খাল থেকে মেশিন দিয়া পানি ভরি তিন দিন পর পর। হাফ লিটার তেল খরচ হয়। এই ড্রেন থেকেই গাছে পানি শুইশা নেই। গাছের গোড়ায় গোড়ায় গিয়া আমার পানি দেওয়া লাগেনা। ড্রেনের পানি আমার আরেক উপকারে আসে। সকাল বেলা শাক কাটতে সময় লাগে। তাই আগের দিন শাক আটি বাইন্দ্যা ড্রেনের পানিতে ডুবাইয়া রাখি। এতে শাক টাটকা থাকে। এইখানে চারদিকে বোরো ধানের জমি। এই কারণে পোকা মাকর বেশি। আমার শাক সবজিতে যেন পোকা না আসে তার জন্য সবজির পাতাগুলা সব সময় পাতলা রাখি। গাছের নিচে আলো বাতাশ ঠিকমত ঢুকলে পোকা বেশি কাটতে পারেনা। বাজার একটু দূর হওয়ায় ভাড়ে সবজিগুলো বহন কইরা নিতে আমার কষ্ট হয়। কিন্তু বেশি পরিমাণে সবজি বিক্রির উপযুক্ত হইলেই পাইকারদের সাথে চুক্তি করমু। তহন তারাই আইসা নিয়া যাইব।
বারসিকনিউজ:বর্ষাকালে আফালের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য কি করবেন?
খোরশেদ মিয়া: বর্ষাকালে আফালের হাত থেইকা বাড়ি রক্ষার জন্য এখন থেকেই একটু একটু কইরা বাড়ির ভিট উচু করতেছি। আমার জমির চারদিক দিয়া উজাউড়ি (কলমি গাছ) গাছ লাগাইতেছি। যেন গাছগুলা আফালের আঘাত ফিরাই। গাছপালাও লাগাইতেছি। এই গুলোও আফালের হাত থেকে আমার বাড়ি রক্ষা করব। টিউবওলেটাও আরো উচু কইরা দিব। যেন খাবার পানির সমস্যা না হয়। হেই সময় আমি সবজি চাষ করতে পারতামনা। দোকানও চলবনা। কারণ এই দিক দিয়া তহন মানুষের আসা যাওয়া থাকবোনা। ঐ সময় মাছ ধইরা সংসার চালাইতে হইব। নিজেদের যাতায়াতের লাইগ্যা ছোট্ট নৌকাও বানাইতে হইব।
বারসিকনিউজ :আপনার সংগ্রামী জীবন সফল হইক
খোরশেদ মিয়া: দোয়া করবেন। আবার আসবেন।
বারসিকনিউজ : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
খোরশেদ মিয়া: আপনাকেও ধন্যবাদ।