মাটির টালি বানিয়ে সোনিয়া ও সুমনার শিক্ষা
দেবদাস মজুমদার, বিশেষ প্রতিনিধি, উপকূলীয় অঞ্চল
চরম দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়ছে সোনিয়া ও সুমনা দুই বোন। শ্রমজীবী পরিবারের মেয়ে সন্তানের অনিবার্য জীবন সংগ্রামে তবু ওরা পরাস্ত নয়। শ্রম দিয়ে বেঁচে থাকা সেই সাথে শিক্ষার আলোয় টিকে থাকার জন্য সোনিয়া ও সুমনার অদম্য লড়াই। দুই বোন শ্রম দিয়ে একদিকে সহায় সম্বলহীন পরিবারে অর্থের জোগান দিচ্ছে আর সেই সাথে লেখাপড়াটাও চালিয়ে যাচ্ছে ওরা। অদম্য দুই বোনের এ জীবন সংগ্রাম সুবিধাবঞ্চিত যে কোন নারী শিক্ষার্থীর জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। মাটির তৈরি টালি (তৈজষসপত্র) তৈরি করে পরিবারের আয়বৃদ্ধির সাথে দুই বোন আজ কলেজ পর্যন্ত লেখাপড়া এগিয়ে এনেছে। মাটির টালি বানিয়ে অর্থ আয় করেই নিজেদের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছে ওরা। সেই সাথে পরিবারের আয় বৃদ্ধি। পাঁচ সদস্যের দরিদ্র পরিবারে দুই বোন বোঝা হওয়ার কথা থাকলেও সোনিয়া ও সুমনার বেলায় তা ঘটেনি। কলেজ পড়–য়া শ্রমজীবী এ দুই অদম্য নারী জীবনে শিক্ষার আলোয় জীবন গড়তে চরম দারিদ্র্যতার সাথে নিয়ত লড়ছে।
পিরোজপুরের কাউখালী সন্ধ্যা নদীর তীরবর্তী সোনাকুর গ্রামের পালপাড়ার বাসিন্দা দরিদ্র মাটি শ্রমিক বাবুল খন্দকারের মেয়ে সোনিয়া ও সুমনার শিক্ষা রুখতে পারেনি দারিদ্র। হত দরিদ্র পিতার মুখ পানে তাকিয়ে না থেকে নিজদের লেখাপড়া ও আহার যোগাতে মাটির তৈরি টালি বানানোর কাজ করে ওরা। এটা দুই বোনের সেই শিশু বেলা থেকেই চলছে। আর এখনও এটা ওদের প্রাত্যহিক শ্রমের কাজ। তবু ওরা শিক্ষা জীবন থেকে ঝড়ে যায়নি। পিরোজপুরের কাউখালী মহাবিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সোনিয়া আক্তার আর একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী সুমনা আক্তার। শ্রমজীবী দুই বোন দারিদ্রতাকে চ্যালেঞ্জ করে শিক্ষায় অদম্য মেধাবী এখন।
স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে, কাউখালীর সন্ধ্যা নদীর ভাঙনে ভিটে মাটি হারিয়ে বাবা বাবুল খন্দকার দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। নদীভাঙা বাবুল খন্দকার জমি আর বসতি হারিয়ে পাঁচ সদস্য নিয়ে চরম বিপাকে পড়েন। একপর্যায়ে সন্ধ্যা নদীতে ট্রলারে যাত্রী পারাপারের কাজ শুরু করেন তিনি। তিন সন্তানসহ পাঁচ সদস্যের পরিবারের দু’বেলা খাবার তো দুরের কথা সেখানে সন্তানের লেখাপড়া চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। সবার বড় ছেলে হাসান খন্দকার ঢাকায় একটি গার্মেন্টসের শ্রমিক। কিন্তু যে বড় ছেলের সংসারের হাল ধরার কথা এবং অসহায় পরিবার আর দুই বোনের পাশে থাকার কথা, সেই ছেলে এমন পরিবারে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেলে সোনিয়া ও সুমনা পরিবার চরম অসহায় হয়ে পড়ে। বাবা বাবুল খন্দকারের আয়ের টাকায় সংসার চালানোই কষ্ট। সেখানে দুই মেয়েদের লেখাপড়া করানো সত্যিই একটি দুরূহ বিষয়। লেখাপড়ার খরচ বহন করা বাবা-মায়ের পক্ষে কষ্টকর দেখে মেধাবী দুই বোন বেছে নেন পালপাড়ায় মাটির টালি আর মাটির বাসন কোষণ তৈরির কাজ । সেই সাথে চলছে কলেজের লেখাপড়া। এ লড়াই এখন ওদের জীবনে অনিবার্য।
কলেজ ছাত্রী সোনিয়া আক্তার জানায়, সোনাকুর পাল পাড়ায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে ওরা সেই স্কুল জীবন থেকে। মাটির সঙ্গেই সখ্যতা আর নদী তীরের জীবন ওদের। ১০০০ মাটির টালি বানালে মজুরি হিসেবে ১৫০ টাকা মজুরি পায় ওরা। এতে যে আয় হয় তা দিয়েই চলে কলেজ পড়–য়া দুই বোনের পড়াশুনার খরচ। বাকি যা অবশিষ্ট থাকে তা বাবার হাতে তুলে দেন। এভাবেই চলছে ওদের লেখাপড়া ও বেঁচে থাকার অদম্য লড়াই। পড়াশনার ফাঁকে অবসরে ওরা মাটির জিনিসপত্র তৈরিতে শ্রম দেয়। আর এসব কাজের ফাঁকে ওরা দুই বোন উপজেলা সদরে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এছ্ড়াা কাউখালী যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকেও বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছে ওরা। অদম্য মেধা আর ইচ্ছাশক্তির বলে এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে ওরা। ওরা এখন স্বচ্ছন্দ জীবনের স্বপ্ন দেখছে। লেখাপড়া করে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে পরিবারের অভাব মোচন করতে চায় ওরা।
সোনিয়ার ছোট বোন কলেজ ছাত্রী সুমনা আক্তার বলেন, “ছোটবেলা থেকে শখে মাটির টালি তৈরির কাজ করতে করতে এখন তা জীবনের একমাত্র অবলম্বন হয়ে পড়েছে। এছাড়া আমাদের বাঁচার আর কোন পথ নেই। লেখাপড়ার কোন উপায় ছিলো না। শত অভাব কষ্টেও লেখাপড়া ছাড়িনি। লেখাপড়া করেই জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখছি আমরা।” সোনয়িা আর সুমনার শ্রমজীবী বাবা বাবুল খন্দকার বলেন, “ওদের ভরপটে খাবার তো দূরের কথা। পড়াশুনার খরচ চালানো সম্ভব না। ওরা নিজেরা কাজ করে আয় করে পড়ছে, পরিবারের সাহায্য করছে। ওরা আমার মাইয়া না ওরা আমার দুই ছেলের চেয়ে অধিক কিছু।”
কাউখালী শিক্ষানুরাগী আব লতিফ খসরু বলেন, “দরিদ্র দুই বোনের শিক্ষা জীবনের জন্য এমন লড়াই একটা দৃষ্টান্ত। ওরা মেধাবী এবং ওরা অদম্য। এরাই জীবনে বহু দুর যাবে। তবে ওদের সহায়তা প্রয়োজন। ওদের সহায়তার জন্য এগিয়ে আসতে পারেন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান সংস্থা ও প্রশাসন। এতে ওদের লেখা পড়াটা নির্বিঘœ হবে।” কাউখালী মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. সাইদুর রহমান বলেন, “সোনিয়া ও সুমনা মেধাবী শিক্ষার্থী। তবে ওরা অতি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। প্রতিদিন লড়াই করেই ওদের বাঁচতে হচ্ছে। শত কষ্টেও ওরা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়েনি। পরিবারের বোঝা নয় ওরা পরিবারের সম্ভাবনা।”