নেত্রকোনার ঋষি সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকা
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
আমারি দেশ, সব মানুষের, সব মানুষের।
ছোটদের বড়দের সকলের, গরীবের নি:স্বের ফকিরের।।
মানুষের মাঝে শ্রেণি বিভেদ বা উঁচু নিচু জাতির পার্থক্য মানুষই সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের সকল মানুষ সমান। সমাজে বসবাস করার অধিকার সকল শ্রেণির মানুষেরই রয়েছে। রয়েছে তাদের সকল ধরণের নাগরিক সেবা প্রাপ্তির অধিকার। বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষ বাস করে। এই সব জাতি ও ধর্মের মানুষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নানান জাতি ও ধর্মের মধ্যে ঋষি সম্প্রদায় অন্যতম।
নেত্রকোনা জেলা সদরের একটি এলাকা মালনী। এই এলাকাতেই ঋষি সম্প্রদায়ের লোকজনের (১৩৫টি পরিবার) বসবাস প্রায় শত বছর ধরে। এঁদের প্রধান ও আদি পেশা হলো চামড়ার সাহায্যে জুতা তৈরি ও চামড়ার ব্যবসা। তবে পেশাটিও এখন আর আগের মতো নেই। কারণ জুতা তৈরির জন্য এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। তাই এই শ্রেণির মানুষেরা বর্তমানে অন্যান্য পেশার দিকে ঝুঁকছে। সেখানেও তারা শ্রেণি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন অহরহ।
মালনী এলাকার স্থানীয়দের তথ্যমতে, পাকিস্তান আমল (১৯৪৮-১৯৭১ সাল) থেকেই এই এলাকায় ঋষি সম্প্রদায়েরা বাস করে আসছেন। এই জায়গাটি তখন ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। কেউ একজন এসে এই জায়গা কিছুটা পরিষ্কার করে বসবাস শুরু করেন। এরপর আস্তে আস্তে অনেকেই আসতে থাকেন এবং তারা তাদের মতো করে এই জায়গাটিকে বসবাস উপযোগি করে তুলেন। ঋষিপাড়ার এক পাশের সমতল জায়গা থেকে মাটি কেটে জায়গা উঁচু করতে গিয়ে সেই সমতল জায়গাটি এখন একটি খালে পরিণত হয়েছে।
ঋষি সম্প্রদায়ভূক্ত পরিবারগুলো বাঙালি। তারা সাধারণত বাংলা ভাষাতেই কথা বলেন। তবে কথার শেষে একটু টান্ দিয়ে কথা বলেন। কিন্তু এদের আদি নিবাস কোথায় তা সঠিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি। জানা যায়, ঢাকা, জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলার কিছু অংশে এই শ্রেণির মানুষদের বসবাস করেন। এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিভিন্ন পূজা, সংক্রান্তি, কীর্ত্তন ইত্যাদি উদ্যাাপন করেন। তবে চৈত্র মাসে ‘চড়ক পূজা’ নামে একটি পূজা হয়, যা একমাত্র এ সম্প্রদায়ের মানুষেরাই পালন করেন।
ঋষি সম্প্রদায়ভূক্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার হার খুবই কম। বারসিক পরিচালিত একটি সমীক্ষার তথ্যমতে, ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শতকরা ২১.৫ ভাগ, ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ১৬.৩ ভাগ ও ১৪.৮ ভাগ মানুষ স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন। এছাড়া বাকি ৪৭.৪ ভাগ অর্থাৎ একটি বৃহৎ অংশ নিরক্ষর। তারা বিভিন্ন কাজে টিপসই ব্যবহার করেন। এই এলাকায় যখন ‘ওয়ার্ল্ড ভিশন’ নামে একটি সংগঠন কাজ করতো (প্রায় ২০ বছর আগে) তখন কিছু নারী ও পুরুষ স্বাক্ষর করতে শিখেছিলেন। তাদের ছেলে মেয়েরাও সেই স্কুলে পড়তো। উক্ত সংগঠনটি তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে চলে যাবার পর আর কোনো পরিবার তাদের পড়ালেখা চালিয়ে যায়নি। এ সমস্ত পরিবারের ছেলে মেয়েরা কেউ কেউ স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হয়েছিল, তবে তা ঐ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।
ঋষি সম্প্রদায়ের সাথে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহও কম। এক্ষেত্রে তাদের সামাজিক অবস্থানও কিছুটা দায়ী। নি¤œ সম্প্রদায়ভূক্ত বলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের অবহেলার চোখে দেখা হয়। মেয়েরা রাস্তায় বের হলে বিভিন্নজন নানা কথায় উত্যক্ত করে। ফলে তারা বাড়ি থেকে বের হতে পারেনা। আর পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে ছেলেরা একটু বড় হলেই সেলুনে বা দোকানে কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। তাই তাদের পড়ালেখা করা আর হয় না। তাছাড়া এই এলাকায় অনেকদিন যাবৎ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করছে না। যে কারণে এই বিষয়গুলোতেও তাদের সচেতনতা কম।
এই এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১৮.৫ ভাগ পরিবারের মাসিক আয়ের পরিমাণ ১৬-২০হাজার টাকা। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, যে পরিবারগুলোতে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা বেশি (৩-৪জন) তারাই শুধুমাত্র এই পরিমাণ অর্থ আয় করতে পারেন। ৪১.৫ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় ৫-১০ হাজার টাকা। চামড়ার ব্যবসা, সেলুনে চুল কাটা ছাড়াও রিকশা চালানো, মাছের আড়তে শ্রমিক, বাজারে মুদির দোকানে কর্মচারী হিসেবেও কাজ করেন। কোনো কোনো পরিবারের নারী সদস্যরাও প্রয়োজনের তাগিদে অন্যের বাড়িতে দৈনিক মজুরিতে কাজ করে।
পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে তাঁরা সদর হাসপাতাল থেকে সেবা গ্রহণ করেন বেশি। কারণ এখানে স্বল্প মূল্যে ঔষধ সংগ্রহ করা যায়। প্রাইভেট চেম্বারে কোনো ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য তাঁদের নেই। গর্ভবতী নারীরা মাতৃ সদনের চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন। সন্তান প্রসব বা এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পরামর্শ গ্রহণের জন্য তাঁরা মাতৃসদনে যান। শিশু, প্রবীণ, নারী ও পুরুষ সদর হাসপাতালে যান। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে অর্থাৎ সদর হাসপাতালের চিকিৎসায় সুস্থ্য না হলে তাঁরা ফার্মেসির ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।
বারসিক পরিচালিত একটি সমীক্ষার তথ্যমতে, ৭৭.৮ শতাংশ পরিবারের নিজস্ব কোন পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। কেউ খোলা জায়গায় বিশেষ করে শিশুরা, কেউ আবার যৌথ ব্যবস্থাপনার ল্যাট্রিন ব্যবহার করেন। অনেকগুলো পরিবার মিলে একটা ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। ২২.২ শতাংশ পরিবার খোলা ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। যে কারণে বেশিরভাগ সময় সেখানে দুর্গন্ধ বের হয়। জায়গার স্বল্পতা ও ল্যাট্রিন তৈরি করার সামর্থ্য না থাকায় এই পরিবারগুলো দিনের পর দিন এভাবেই বসবাস করছে।
এই এলাকার প্রতিটি পরিবার বিদ্যুৎ সুবিধার আওতাভূক্ত। বিদ্যুতের সাহায্যে লাইট, ফ্যান চালায়। ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করে। কোনো কোনো পরিবারে টেলিভিশনও আছে। এই এলাকার কোনো পরিবার সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করেনা। উন্নত চুলা বা বন্ধু চুলা এখানে কেউ ব্যবহার করেনা। তিন বেলা রান্না করার জন্য প্রতিটি পরিবার নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি মাটির চুলা ব্যবহার করেন। স্থানীয় কাঠের মিল ও একজন লাকড়ি বিক্রেতার কাছ থেকে তারা লাকড়ি, ভূষি ইত্যাদি কিনে আনে। মিল থেকে সরাসরি লাকড়ি কিনে আনলে দাম পড়ে মণ প্রতি ১৫০ টাকা। লাকড়ি ব্যবসায়ী এক মণ লাকড়ির দাম নেয় ২৫০ টাকা। বর্ষাকালে আবার ৩০০ টাকা বা তারও বেশি টাকা মণ দরে লাকড়ি কিনতে হয়। তবে সেই লাকড়ি বেশিরভাগ সময়ই ভেজা থাকে। বাড়িতে এনে রোদে দিয়ে শুকাতে হয়।
ঋষি সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো সারাবছর টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করেন। বেশিরভাগ পরিবারেই নিজস্ব টিউবওয়েল আছে। কিন্তু পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকার কারণে ব্যবহার করতে পারেনা। শুধুমাত্র খাল পাড়ে যাদের বাড়ি তারা টিউবওয়েল ব্যবহার করেন। কারণ পানি নিষ্কাশনের জন্য তাঁরাা কলের পাড় থেকে খাল পর্যন্ত একটি নালা কেটে দেন। পৌরসভা থেকে সরবরাহকৃত পানির লাইনও এই এলাকায় নেই। এলাকার উত্তর দিকে একটি বিল আছে। তবে বাড়ি থেকে অনেক দুরে থাকার কারণে এটি দৈনন্দিন কাজের জন্য কেউ ব্যবহার করতে পারেনা। এলাকায় ব্যক্তি মালিকানায় একটি পুকুর আছে। অনেক বছর আগে সেই পুকুরের পানি গোসলসহ বিভিন্ন কাজে সবাই ব্যবহার করতে পারতো। এখন এটির পাশে একটি বেসরকারি কলেজ স্থাপিত হওয়ায় তা কলেজের সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাই এটি ব্যবহারে এখন নিষেধাজ্ঞা তৈরি হয়েছে। যদিও বা কেউ গোসল করতে যায় তবে খুব ভোরে আর লুকিয়ে যেতে হয়।
অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা ও সামাজিক কারণে এই জনগোষ্ঠীর পরিবারগুলো নিতান্তই দুরবস্থার মধ্যে দিন যাপন করছে। প্রয়োজনীয়তা সত্বেও নিজেদের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে পারছেন না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন নয়। সামাজিক কারণে অনেক পরিবারই তাদের মেয়েদের বাল্য বিবাহ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। গর্ভবতী ও শিশুদের পুষ্টিকর খাবার, বাল্য বিবাহ, নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, স্যানিটেশন ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা এখনো সচেতন নয়। এই জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা উন্নয়নে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে সেটা সরকারি বা বেসরকারিভাবে হলেও, যা বারসিক ইতিমধ্যে শুরু করেছে।