হাওয়া আক্তার একজন আত্মবিশ্বাসী নারী
ঢাকা থেকে পাভেল পার্থ
গ্রাম পুলিশদের কাজ হলো গ্রামের মানুষদের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে প্রায় ১২ থেকে ১৩ জনের মতো গ্রাম পুলিশ থাকেন। তবে এ কাজে মেয়েদের সংখ্যা কম। বিদ্যমান নানা বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এ কাজে অংশ নিতে মেয়েদের পিছিয়ে রাখে। নেত্রকোণার আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের স্বরমুশিয়া গ্রামের হাওয়া আক্তার এ দিক থেকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। তিনি একজন সফল ও সক্রিয় গ্রাম পুলিশ। তবে শুধু এটুকুতেই তার বিরাট কর্মপরিসরের পরিচয় শেষ হয়ে যায় না। গ্রাম থেকে গ্রাম তার রয়েছে সামাজিক কাজের এক মজবুত ভিত্তি। সন্তোষেন্নেসা এবং মো. ছৈয়দ আলীর ৮ সন্তানের ভেতর হাওয়া আক্তার সকলের বড়। জন্মেছেন ১৯৬৮ সালে স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের গিডুয়ারি গ্রামে। স্বরমুশিয়া আলিম মাদ্রাসা থেকে ৮ম শ্রেণি পাশ করেছেন।
পরবর্তীতে আনসার-ভিডিপি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কৃষি, জৈবকৃষি, প্রাণিসম্পদ, জেন্ডার, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, হস্তশিল্প, সেলাই প্রশিক্ষণ, টিকা কর্মসূচি, নবজাতক ও গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য, স্যানিটেশেন, সামাজিক বনায়ন ও মানবাধিকার বিষয়ে প্রায় শতাধিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিয়ের পর চলে আসেন স্বরমুশিয়া গ্রামে এবং বর্তমানে এখানেই বাস করছেন। ২ কন্যা ও ২ পুত্রের সকলকেই পড়াশোনা করাচ্ছেন। গ্রামের গরিব পরিবারের নারীদের নিয়ে কুটিরশিল্পী অধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘হাবাদা (হাত-বাঁশ-দা)’ গড়ে তুলেছেন। তিনি একইসাথে স্বরমুশিয়া ইউনিয়ন পরিষদের স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য। এছাড়া সাবলম্বী নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাসনা সমিতির সভানেত্রী, বনবিভাগের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির সংগঠক ও স্থানীয় পর্যায়ে একজন সক্রিয় মানবাধিকারকর্মী। নিজের চেষ্টা ও পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে তিনি এক তৃণমূল গ্রামীণ সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতাকে প্রশ্ন করে চলেছেন এবং পরিবার ও সমাজে নারীর অবস্থান ও স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে চলেছেন। হাওয়া আক্তার স্বপ্ন দেখেন নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা সবাই একই মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে বড় হবে। নারী-পুরুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না। নারী ও পুরুষের যৌথ অংশগ্রহণেই তৈরি হবে এক নতুন বাংলাদেশ। হাওয়া আক্তারের আত্মজৈবনিক বয়ান থেকে তৈরি হওয়া চলতি লেখাটিতে খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁর শিক্ষা, দর্শন, স্বপ্ন ও সংগ্রাম।
গালমন্দ টপকানোর সাহস
১৯৮৫ সাল। ভূমি ও নারী-পুরুষের সমঅধিকার বিষয়ে একটা প্রশিক্ষণ হবে উপজেলা পর্যায়ে। গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে পুরুষেরা পছন্দ করতেন না মেয়েরা বাইরে যাবে। সভা-সমিতি করবে, প্রশিক্ষণ নেবে, গ্রামের বাইরে গিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য কোনো আবাসিক প্রশিক্ষণকেন্দ্রে থাকবে। হাওয়াকে পরিবার ও প্রতিবেশীরা গালমন্দ করেন। হাওয়া গিডুয়ারির রেজিয়া বেগম নামে একজন মেয়েকে রাজি করান। তারা নানা গালমন্দ পেছনে ফেলে সেই প্রশিক্ষণে যোগ দেন এবং সাফল্যের সাথে তা শেষ করেন। গ্রামে ফিরে তারা গ্রামের গরিব ভূমিহীন নারী-পুরুষদের নিয়ে গঠন করেন ‘ভূমিহীন একতা সমিতি’। হাওয়াকে সবাই সমিতির সভানেত্রী বানায়। কিছু সরকারি খাস জমি বন্দোবস্তী পায় ভূমিহীনরা। গ্রামের মানুষ হাওয়াদের ক্ষমতা দেখে অবাক হয়। যারা একসময় গালমন্দ করেছিল তারা কিছুটা সম্মান দেখাতে শুরু করে। তবে রেজিয়াকে আর এই কাজে পাওয়া যায়নি, পরিবারের কারণে তারা গ্রাম ছেড়ে কোথায় যেন চলে যায়।
গর্বের কালো রঙ
হাওয়া যখন মাদ্রাসায় পড়েন তখন স্থানীয় মুসলিম পরিবারগুলোতে মেয়েদের জন্য খুব পর্দাপ্রথা ছিল। বিয়ের পর গায়ের রঙ কালো বলে হাওয়া মানতে পারেনি তার স্বামীর পরিবার। নানা গঞ্জনা ও বঞ্চনা সইতে হয়েছে। তিন মাসের কন্যা সন্তান রেখে তার স্বামী চলে যায় এবং আরেকটি বিয়ে করে। এক মনোবল ছাড়া হাওয়ার আর কোনো সম্বল তখন ছিল না।
১২ বছরের এক দ্বন্দ্ব
রামজীবনপুরের খেলন রানীর পরিবারে ১২ বছর ধরে এক দ্বন্দ্ব চলছিল। টাকা পয়সারও টানাটানি ছিল। হাওয়া আক্তার নিজে বিশ হাজার টাকা জোগাড় করেন এবং তাদের পারিবারিক বিবাদও মিটিয়ে দেন। খেলন রানীর মেয়েরা এখন গার্মেন্টসে চাকরি করে। নিজে এক শতক জায়গা রেখেছে, ১০ কাঠা জমি বন্ধক রেখেছে।
কুসুম কুসুম স্বর্ণরেণুগুলো
হাওয়া আক্তার এ পর্যন্ত নিজে প্রায় ষাট জন নারীর নিরাপদ প্রসব করিয়েছেন। দশটির মতো বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করেছেন। গরিব পরিবারের বিয়ের খরচ, লেখাপড়ার খরচ, চিকিৎসার খরচ জোগাড় করে দিচ্ছেন। গাছ থেকে পড়ে মতিউর রহমান পা ভেঙেছিল। চিকিৎসার জন্য প্রায় পাঁচ হাজার টাকা সংগ্রহ করেছেন। জোলেনা বেগম, আঙ্গুরা বেগম ও নাসিমা বেগম প্রসব জটিলতায় ভুগছিলেন। হাওয়া তাদের নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গেছেন। জন্মের পর সালমা বেগমের বাচ্চা মারা যায়। টাকা ছাড়া হাসপাতাল বাচ্চার লাশ দিয়ে চাইছিল না। হাওয়া সেই টাকা জোগাড় করে মৃত নবজাতককে ময়মনসিংহ হাসপাতাল থেকে নেত্রকোণা এনে দাফনের ব্যবস্থা করেন। এলাকার প্রবীণদের বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া তার অন্যতম কাজ। গ্রামের আইন-শৃংখলা রক্ষার একটি প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব থাকলেও হাওয়া সব সময় গ্রামের মেয়েদের নিরাপত্তার দিকটি বেশি জোর দেন।
হাওয়ার অনুসরণকারীগণ
একদিনে নয়, প্রতি মুহূর্তেই কাজের ভেতর দিয়ে হাওয়া হয়ে ওঠছেন একজন পরিচিত সমাজকর্মী। অনেক মেয়ে এখন তাঁকে অনুসরণও করছে। নিজ গ্রাম নয়, অনেক দূরের গ্রাম থেকেও নারীরা তার কাছ থেকে নানা পরামর্শ নিতে আসে। স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের মাজেদা, সখিনা, হারো, আল্হাদের মা, আছিয়া, আম্বিয়া, জোসনা ও কাছুনীর মতো অনেকই এক একজন হাওয়ার মতো করে গড়ে তুলছেন নিজেকে।