গো খাদ্যের ঘাটতি মোকাবিলায় ভূমিকা রাখছে কচুরিপানা লতাপাতা
চাটমোহর থেকে ইকবাল কবীর রনজু
“পরায় তিরিশ বছর হলো। বড় বান আইছিল সে বছর। ব্যাটা গারে কুটি কুটি থুয়্যা ওগারে বাপ মর্যা গ্যাছে। শ^শুর কুলির বাপের কুলির পক্ষ থেকে কোন জমা জমি পাই নাই। ৬ শতক বসত বাড়ি ছাড়া আর কোন সয় সম্পত্তি নাই। আবাদ বসতও নাই। চাল ডাল কিন্যা খাতি জান বারায়া যায়। সাতটা গরু। পাঁচটা গাই। দুইড্যা বাছুর। খেড়, খৈল, ভূষি, ভুট্টা, নুন কিনতি মেলা ট্যাকা লাগে। নিজিরাই খাবো পরবো নাকি গরুক খাওয়াবো। কি করবো বাপু? দুই চোখে দেখপার না প্যারা লাতিক সাতে কর্যা গাঙের ভিতর কচুর পানা কাটপ্যার আইছি। ছাওয়াল পাল লাতি পুতি লিয়া গরুগুলো লালন পালন করি।” পাবনার চাটমোহরের বিলচলন ইউনিয়নের দোলং গ্রামের পাশে অবস্থিত মৃতপ্রায় বড়াল নদীর বুকে গরুকে খাওয়ানোর জন্য কচুরিপানা কাটার সময় মাঝ নদীতে কচুরিপানার স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলেন চাটমোহরের বোঁথর গ্রামের মৃত আয়নাল হোসেনের বিধাব স্ত্রী ফাতেমা খাতুন (৫৫)। ফাতেমার নাতি, স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র উজ্জ্বল দাদীর সাথে কচুরিপানা কাটার সময় জানান, গরু বাছুর পালা খুব কঠিন হয়া পরছে।
বোঁথর গ্রামের আলম হোসেনের স্ত্রী আয়নব খাতুন (৩৫)। কচুরী পানার স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে মস্ত বড় লগি দিয়ে স্তুপটি সবুজ কচুরিপানার দিকে এগিয়ে নিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলেন। তিনি জানান, দুইটি গাভী, একটি এঁড়ে ও একটি বকনা বাছুর রয়েছে তাদের। বর্ষার পানি এখনো বিল থেকে নামে নাই। গোচারণ ভূমি পানির তলে এখনো। গাভী দুইটি ১৫ লিটার দুধ দেয়। কাঁচা ঘাস খাওয়ালে গরুর দুধ বাড়ে। কাস্তির সময় গাভী দুইটা ৩৪ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়েছে। মিলে প্রতি লিটার দুধের দাম পাওয়া যায় ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। ফ্যাটের উপর দুধের দাম নির্ধারণ হয়। বকনা ও দুটি গাভী আবার বাচ্চা দিবে। পাঁচ শতক বসতবাড়ি ব্যতিত অন্য কোন জায়গা জমি নেই। গো খাদ্যের দাম বেশি। তাই সকালের রান্না বান্না এবং কাজ কর্ম শেষ করে বড়াল নদীতে এসেছেন গরুর জন্য কচুরিপানা কাটতে। স্বামী এবং তিনি মিলে কষ্ট করে গরুগুলো পালন করছেন বলে জানান।
চাটমোহর-ছাইকোলা সড়কের দোলং গ্রামে রাস্তার পাশে দেখা মেলে আব্দুল জলিল (৫০) এর সাথে। গরুকে খাওয়ানোর জন্য রাস্তার পাশে লতাপাতা কাটছিলেন। তিনি জানান, দুইটি গরু আছে তার। একটি গাভী একটি এঁড়ে। গাভীটি ১৩ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়েছে। এখন ৬ লিটার দিচ্ছে। দুইটি গরুকে প্রতিদিন ৬ কেজি খৈল, ৬ কেজি গমের ভুষি, অন্তত ১শ’ আটি খড় খেতে দিতে হয়। খড় গমের ভূষি লবন সব মিলিয়ে দুটি গরুর পেছনে প্রতিদিন অন্তত ৯শ’ টাকা খরচ হচ্ছে। তাছাড়া নিজের বাড়তি শ্রম তো আছেই। বাড়িতে বোঝা খানেক খড় আছে। তিনি বলেন, “ভর পেট খাওয়ার দিলি দুই দিনে শেষ হয়ে যাবি। গরু পালন করলে দুধ, বাছুর ও জ্বালানি পাওয়া যায়। পাঁচ বিঘা জমি আবাদ করি। বর্ষাকালীন গোবর থেকে যে জৈব সার হয় তা জমিতে প্রয়োগ করি। বিভিন্ন দিক চিন্তা করে কষ্ট হলেও গরু পালন করছি। অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি রাস্তার পাশের খোঁকসা পাতা, আম কাঁঠালের পাতা, দূর্বা ঘাস, কলাডিমার পাতাসহ অন্যান্য লতা পাতাও কেটে খাওয়াচ্ছি গরুকে।”
নদীর বুকে কচুরিপানা কাটছিলেন রাসেল সরদার। কেটে বোঁঝা বেঁধে রাখা কচুরিপানাগুলো নদী থেকে তুলে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন তার বাবা আশরাফ সরদার। গোখামারী রাসেল জানান, ৬টি গরু পালন করেন তিনি। চারটি গাভী। দুইটি বাছুর। বাবা সার্বক্ষণিক সহায়তা করেন। গো খাদ্য সংকট প্রকট হওয়ায় এ এলাকার খড় ব্যবসায়ীরা যশোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহসহ উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে ট্রাক যোগে খড় এনে বিক্রি করছেন। আটির আকার ভেদে প্রতি একশ আটি খড় ৪শ’ থেকে ৮শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খামারীরা যে যার সাধ্যমতো খাওয়াচ্ছেন। ৬টি গরুর পেছনে খড়, খৈল, গমের ভুষি, লবন, ভুট্টার গুড়াসহ অন্যান্য খাদ্য বাবদ প্রতিদিন অন্তত দেড় হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে তাকে। গাভীগুলো এখন দুধ দিচ্ছে না বলে খাবারের পরিমাণ ও কম দিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
ফাতেমা, উজ্জ্বল, আয়নব, জলিল, রাসেল,ভাঙ্গুড়ার অষ্টমনিষা ঘোষ পাড়ার দেল মাহমুদ শেখ, বোঁথর গ্রামের হায়দার আলীসহ অন্যান্য গো খামারীরা জানান, এ চিত্র কেবল চাটমোহরের নয়। চাটমোহর ও এর আশপাশ এলাকা ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, তাড়াশ, সিংড়া, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর সর্বত্র তীব্র গো খাদ্য সংকট বিরাজ করছে। হাজার হাজার খামারী নদী, বিল, বাড়ির পাশর্^বর্তী মজা পুকুর থেকে কচুরিপানা লতাপাতা কেটে তুলে দিচ্ছেন গরুর মুখে।
এ ব্যাপারে চাটমোহর উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. স্বপন চন্দ্র দেবনাথ বলেন, “চাটমোহরে ৮৯ হাজার ১শ’ ৪২টি গরু ও ৫শ’ ২০টি মহিষ রয়েছে। ৩শ’ ২৮টি গাভীর খামার, ৩৮টি ছাগল ও ৩৮টি ভেড়ার খামার রয়েছে। সাধারণত কারো বাড়িতে তিনের অধিক গরু মহিষ থাকলে সেটাকে খামার বলা হয়।” তিনি আরও বলেন, “এ বছরের বন্যায় চাটমোহরের তিনটি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সার্বিক বিবেচনায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা হওয়ায় আগাম বোনা আমন ধান এবং খামারী ও কৃষকের উন্নত জাতের ঘাসক্ষেতগুলো ডুবে যাওয়ায় গো খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে নতুন ধান পুরোপুরি কাটা শুরু হলে এ সংকট কমবে আশা করছি।” গরু বাছুরকে কচুরিপানা লতা পাতা খাওয়ানো প্রসঙ্গে তিনি জানান, খড় এবং দানাদার খা¦ারের পাশাপাশি সীমিত আকারে নিরাপদ কচুরিপানা লতা পাতা খাওয়ালে ক্ষতি নেই। তবে বেশি খাওয়ালে পাতলা পায়খানা হতে পারে। কৃষকেরা শর্করা সমৃদ্ধ কচুরিপানা লতা পাতা খাইয়ে গোখাদ্যের ঘাটতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে।