সাতক্ষীরার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
সাতক্ষীরা থেকে মো. আব্দুর রহিম
সাতক্ষীরা জেলায় অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। যেগুলো সংরক্ষণের অভাবে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছে। অচিরেই এগুলোকে সংরক্ষণ করতে না পারলে নতুন প্রজন্মসহ বর্তমানে অনেকের কাছে রহস্য ও অজানা হয়ে থাকবে এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো। বিলুপ্তির পথে পা দেওয়া এই নিদর্শনগুলো অনেকটা আজও বেঁচে আছে। কিন্তু এর বেশির ভাগই আছে অরক্ষিত এবং এর যে সৌন্দর্য তা আজ বিলীন হতে বসেছে। এর পিছনের ইতিহাস তা অচিরেই মাটি চাপা পড়তে বসেছে। এই বহুল ঐতিহ্যেমন্ডিত স্থানগুলো সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। নতুন ও বর্তমান প্রজন্মের কাছে এর কোন সঠিক ইতিহাস থাকছে না। অজানাই মাটি গর্ভে থেকে যাচ্ছে সব ইতিহাস। স্থানীয় প্রশাসনও কোন প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করছে না সেগুলো সংরক্ষণের।
১. যশোহরের শরি কালি মন্দির (চন্ড ভৈরবের মন্দির)
বংশিপুর শাহি মসজিদ ও হাম্মাম খানার পূর্ব পাশে ঈশ্বরিপুর গ্রামে অবস্থিত যশোহরেশ্বরি কালি মন্দির। রাজা প্রতাপ আদিত্ত যশোহর রাজ্যের রাজধানি স্থাপন করেন। এ অঞ্চলে তখন জঙ্গল পরিষ্কার করার সময় ভগ্না অবস্থায় এই মন্দিরটি পাওয়া যায়। তিনি এটি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন। কবি রামের দিক বিজয় প্রকাশ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, রাজা লক্ষণ সেন ঈশ্বরিপুর গ্রামে অবস্থিত যশোহরেশ্বরি এবং তার উত্তর পূর্বকোণে চন্দ্র ভৈরবের মন্দির নির্মাণ করেন।
২. জে সুইট গির্জা
যশোহরেশ্বরি কালি মন্দিরের অনতিদূরে অবস্থিত পাক ভারত উপমহাদেশের প্রথম গির্জা। ১৬০০ খ্রিঃ পহেলা জানুয়ারি গির্জার উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে রাজা প্রতাপ আদিত্ত উপস্থিত হয়েছিলেন। মূল গির্জাটি বিলুপ্ত হয়েছে তবে সেইখানে নতুন করে গির্জা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পুরাতন গির্জাটি পুড়ামাটির কয়েকটি নকশা স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষিত আছে।
৩. হাশেমী বাড়ি
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে অনুপ্রাণিত করেছিলো যে সঙ্গীতাবলী, সিকান্দার আবু জাফরের ‘জনতার সংগ্রাম চলবে’ তার মধ্যে অন্যতম। সাংবাদিক সাহিত্যিক সিকান্দার আবু জাফর এই হাশেমী বাড়ির সদস্য। আরো যারা উল্লেখ্যযোগ্য তারা হলেন সাবেক ডেপুটি স্পিকার- সৈয়দ জালাল উদ্দিন হাশেমী, সাবেক মন্ত্রি সৈয়দ দিদার বক্স, চিত্রকর সৈয়দ জাহাঙ্গীর, সাবেক সংসদ সৈয়দ কামাল বক্স সাকি প্রমূখ। আমরা তাদের কৃতিত্বকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তেতুলিয়া জামে মসজিদের অনতিদূরে এই হাশেমী বাড়ি অবস্থিত।
৪.বংশীপুর ঐতিহাসিক শাহি মসজিদ (ট্যাংগা মসজিদ)
৫ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি ১৫৯৯ খ্রিঃ নির্মিত। একে ট্যাংগা মসজিদ বলা হয়। ট্যাংগা ফারসি শব্দ যার অর্থ সেনা ছাউনি। রাজা প্রতাপ আদিত্তের সেনাপতি খাজা কামাল বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ রাজ কর্মচারী পাঠান ও স্থানীয় মুসলিম সৈনিকদের নামাজের সুবিধার জন্য এটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদের পূর্বপাশে ২১ ফুট একটি ও আরো কয়েকটি বড় বড় কবর দেখা যায়। এগুলো যারা প্রতাপ আদিত্তের সাথে যুদ্ধ করতে এসে নিহত হয়েছিলেন তাদের কবর।
৫. হাম্মাম খানা
বংশীপুর গ্রামের যাশোহরেশ্বরি মন্দির ও শাহী মসজিদের মাঝ বরাবর অবস্থিত হাম্মাম খানা বা স্থানাগার। এটি রাজা প্রতাপ আদিত্তের রাজকীয় অস্থিসালার অংশ এর মধ্যে চৌবাচ্চা, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা, এবং ছাদের গম্বুজে ছিদ্র আছে। ঐ ছিদ্্র দিয়ে ঘরে আলো নেমে আসে আকাশ থেকে। স্থাপনার দু’পাশে ২টি ছোট দরজা রয়েছে মাত্র। শ্যামনগর উপজেলা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪ কিঃমিঃ।
৬.শ্যাম সুন্দর মন্দির (সোনাবাড়িয়া মঠ)
বুদ্ধদেবের শিষ্যরা বুদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য মঠটি তৈরি করেন। কিন্তু ধর্ম চর্চার জন্য পরিবেশ অনুকূল না হওয়াতে তারা চলে যান। পরিত্যক্ত অবস্থায় অনেক দিন পরে থাকার পর ১৭৬৭ খ্রিঃ জমিদার দূর্গাপ্রিয় চৌধুরির পূর্বপুরুষেরা পূণনির্মাণ করে এটি মন্দিরে পরিণত করেন। ৩ তলার মন্দিরটির ৩ তলায় থাকতো সোনার তৈরি রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি। ১১৯৫ বঙ্গাব্দে মন্দির সংলগ্নে একটি ২ তলা ভোগ মন্দির তৈরি করা হয়। মন্দিরে পূর্বপাশে ১২টি ঘরে ১২টি মহামূল্যবান কষ্টি পাথরের শিবলিঙ্গ ছিলো। কলারোয়া থানা থেকে প্রায় ৭ কিঃমিঃ পশ্চিমে এর অবস্থান।
৭.পঞ্চমন্দির (মায়ের মন্দির)
নদীয়ার কৃষ্ণ নগরের রাজা, কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ কর্মচারি কৃষ্ণরাম চক্রবর্তী, তিনি ১৭৭২ খ্রিঃ উলান পরবনা ক্রয় করে জমিদারি শুরু করেন। উলানের গ্রাম সাত ঘড়িয়ায় বসত বাড়ি নির্মিত হয়। এই সাতঘড়িয়া কালক্রমে সাতক্ষীরা নামের উৎপত্তি ঘটায়। বসতবাড়ি সংলগ্ন পঞ্চ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ১২০১ বঙ্গাব্দে, কালিমাতা মন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দির, কাল ভৈরব মন্দির, শিব মন্দির ও রাধা-গবিন্দ মন্দির। এর মধ্যে রাধা-গবিন্দ মন্দিরটি নষ্ট হয়ে গেছে। ওটা নতুন করে তৈরি হচ্ছে। অন্নপূর্ণা মন্দিরটি সব চেয়ে উঁচু এবং এর সারা গায়ে দেব দেবীর অসংখ্য আলপনা। এটি সাতক্ষীরা শহরের সবচেয়ে বড় মন্দির।
৮. জাহাজ ঘাটা নৌদূর্গ
এটি যমুনা নদী পাড়ে অবস্থিত। এই খালে রাজা প্রতাপ আদিত্তের রণতরী তৈরি ও মেরামতের কাজ হতো। মোঘল আক্রমণ প্রতিহত করতে রাজা প্রতাপ আদিত্ত শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করেন। এখানে ছিল তার প্রধান কার্যালয় ও আশ্রয় স্থান। নৌবিভাগের প্রধান ছিলেন পর্তুগিজ নাগরিক ফ্রেডারিক ডুগলি ও করারিগো। জাহাজ ঘাটার এই ভবনটিতে অফিস, মালখানা, শয়ন কক্ষ, ও স্থানাগার ছিলো। মুঘোল বাহিনীর সাথে রাজা প্রতাপ আদিত্তের বাহিনীর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। এই জাহাজ ঘাটা সংলগ্ন যমুনা নদীতে। সময়টা ছিলো ১৭ শতাব্দীর প্রথম দশক, কালের সাক্ষী হয়ে আজ ও টিকে আছে শ্যামনগর উপজেলার খানপুর গ্রামে।
৯. প্রবাজপুর শাহে জামে মসজিদ
সুদৃশ্য টেরাকোটাসমৃদ্ধ এই মসজিদটি ২৪ শে মে ১৬৯৩ খিঃ নির্মিত। মুঘল স¤্রাট আওরাঙ্গজেবের সময় তার ফৌজার নবাব নুরুল উললাহ খাঁ এই মসজিদের নামে ৫০ বিঘা জমি দান করেন। সোবেদার পারভেজ খাঁ স¤্রাটের নির্দেশ ক্রমে সেনাবাহিনীর নামায পড়ার জন্য এটি নির্মাণ করেন। তার নাম অনুসারে এই গ্রামের নাম প্রবাজ পুর।
১০. গোকুলানন্দ পাক বাড়ি
গোকুলানন্দ পাক বাড়ি দেবহাটা থানার অদূরে ইছামতি নদীর তীরে অবস্থিত। ১২৯৭ বঙ্গঃ এটি স্থাপিত। গোকুলানন্দের স্মৃতি ও কাঠের সুদৃশ্য রাঁধা-কৃষ্ণ ঠাকুর।
১১. বনবিবির বটতলা
দেবহাটা উপজেলার কাছাকাছি প্রায় ২ একর জমিজুড়ে অবস্থান করছে দেশের ২য় বৃহৎ বট গাছটি। গাছটি এখন বেড়ে চলেছে শেকরে শেকরে। এর প্রথম কান্ডটি আর বোঝা যায় না।
১২. ছয় ঘড়িয়া শিব মন্দির (জোড়া মন্দির)
সাতক্ষীরা শহর থেকে ৭ কিঃমিঃ দূওে অবস্থিত এই মন্দির জোড়া। পুড়া মাটির লেখা থেকে জানা যায়, ১২২০ বঙ্গাব্দে পহেলা বৈশাখ এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ফকির চাঁদ ঘোষ। অপূর্ব টেরাকাটা নকশা দিয়ে সাজানো যা সহজে মন কেড়ে নেয়।
১৩. লাবসা মসজিদ (দরগা মসজিদ)
হিজরি ১৩০১ সালে জমিদার ইমাদুল হক এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। এটি যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের লাবসায় অবস্থিত। বর্তমানে এখানে মুসললিদের নামাযের ভিড় পড়ে। এটি দরগা মসজিদ নামে পরিচিত।
১৪. দেবহাটার কুঠি বাড়ি (দেবহাটা থানা)
ওপারে ভারতের টাকি এপারে বাংলাদেশের দেবহাটা উপজেলা মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে ইছামতি নদী। নদীর তীরে নীল কুঠি। ১৯০০ খ্রিঃ নির্মিত এই কুঠি বাড়িতে এক সময় নীল কুঠিয়ালরা অবস্থান করেছিলো।
১৫. চম্পা মায়ের দরগা (মায় চম্পার দরগা)
সাতক্ষীরা শহরতলির গ্রাম লাবসা যার আদি নাম লা-বাদসা। নৌখালি নদী বয়ে চলেছে এর দক্ষিণ-পশ্চিম গাঁ ছুয়ে। বাগদাদের এক খলিফার ধর্ম পরায়ণ রূপসী কণ্যা চম্পা। তিনি একদা নৌকায় করে এসে এইখানে নামেন। ঘাটে নেমে নৌকার দড়ি ধরলে নৌকাটি একটি বাঘ হয়ে যায়। তিনি জৈনক আনোয়ার কাজির বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। অল্প দিনের মধ্যে তিনি অলৌকিক ক্ষমতা বলে পরিচিত হয়ে উঠেন। থানা ঘাটার দারোগা ও গণরাজার নায়েব লা-বাতসা তাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে তিনি এইখানে উতত্থান হন। সেই থেকে মানুষ রোগ ও বিপদমুক্তির আশায় এইখানে আসেন। ভিন্ন মতে, এটি গাজি কালো চম্পাবতী উপখানের রাজা মুকুট রায়ের কণ্যা চম্পাবতী। এলাকার মানুষ শ্রদ্ধাভরে চম্পামায়ের দরগা বলে ডাকে। চম্পাবতীর কবরের পাশে তার বাঘের কবরটিও রয়েছে। ৪টি পুরাতন পিলিয়ারের ভগ্নাবশেষ, একটি চম্পাফুল গাছ, আর একটি বৃহৎ বটগাছ মাজারটিকে ঘিরে রেখেছে। এটি সুলতানি আমলের বলে জানা যায়।