শ্যামনগর এগ্রো টেকনোলোজি পার্ক: কৃষি, প্রাণ ও প্রকৃতির পাঠশালা
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে মারুফ হোসেন (মিলন)
পার্কের পরিচিতি
পাবলিক সার্ভস ইনোভেশন এর আত্ততায় সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলা পরিষদের বাস্তবায়নে উপজেলা চত্ত্বরের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে শ্যামনগর এগ্রো টেকনোলজি পার্ক। পার্কটি গত ২০১৫ সালের ২৮ নভেম্বর কার্যক্রম করে। যা ১৬ জানুয়ারী ২০১৬ জেলা প্রশাসক এটি আনুষ্ঠানিক ভাবে শুভ উদ্ভোধন করেন। পার্কটি ৭৫ শতাংশ জমি নিয়ে স্থাপিত। এখানে মৌসুম ভিত্তিক কৃষির সকল জাতের ফসল ট্রায়াল প্লটের মাধ্যমে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ কৃষক এবং কৃষিবিজ্ঞানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদেরকে প্রদর্শনী প্লটে হাতে কলমে শিক্ষা দেত্তয়া হয়। ফলে কৃষি প্রযুক্তি বিস্তারে কৃষকরা সম্মুখ ধারণা পাচ্ছে এবং কৃষির মৌসুম ভিত্তিক পরিবেশ বান্ধব ও সম্পদের সর্বোত্তম ব্যাবহার নিশ্চিত হয়েছে। শ্যামনগর এগ্রো টেকনোলজি পার্কটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এখানে সমন্বিত জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হয়। এছাড়াও জৈব সার ব্যাবহারের নিমিত্তে পার্কটিতে ভার্মি কম্পোষ্ট (ফেবো সার) প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে। শ্যামনগর এগ্রো টেকনোলোজি পার্কটি কৃষি বিভাগের কারিগরি তত্ত্বাবধানে সার্বিক পরিচালনা করছেন শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার।
কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন কলাকৌশল, সংরক্ষণ, প্রশিক্ষণ, বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া প্রদর্শন করে নতুন উদ্ভাবনকে বিস্তারের জন্য এগ্রোটেকনোলোজি পার্ক এবং কৃষকের মাঝে জৈব সার ব্যবহার করে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি বিস্তারের লক্ষ্যে পার্কটি গড়ে উঠেছে।
স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান। জৈব কৃষি সম্পর্কে কৃষক ও জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা। কৃষি জমিতে জৈব সার দিয়ে ফসল উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা। কৃষি ক্ষেত্রে সবগুলো প্রযুক্তি কৃষকদের হাতে কলমে শেখানো। লবণসহিষ্ণু কৃষি ফসল উৎপাদনে কৃষকদের ধারণা দেত্তয়া। কর্মস্থান সৃষ্টি করা এবং ফলজ, বনজ, ওষুধি ও কুড়িয়ে পাত্তয়া সবজির গুনাগুন সংম্পর্কে শিক্ষার্থীদের এবং জনসাধারণকে সচেতন করা। এগ্রোটেকনোলোজি পর্কে মাটির সর্বত্তোম ব্যবহার করে জৈব সার প্রয়োগে বিভিন্ন উদ্ভিদ জন্মানো হচ্ছে।
উদ্ভাবনী প্রযুুক্তির ব্যবহার
লবণাক্ত এলাকায় বাঁশ নির্মিত টাত্তয়ারে সবজি চাষ, ভাসমান সবজি চাষ, দেওয়ালে সবজি চাষ, ভার্মি কম্পোস্ট, কুয়িক কম্পোস্ট, কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি ও ব্যবহার, কোকোডাষ্ট ব্যবহার করে মাটি বিহিন সবজি উৎপাদন, স্বল্প সেঁচে গম, জব, ডাল জাতীয় ও মসলা জাতীয় ফসল উৎপাদন, একই জমিতে এক ফসলের পরিবর্তে ২, ৩, ৪ ফসল উৎপাদন, জমির আইলের উপর সবজি উৎপাদন, ড্রিপ সেঁচ ও স্প্রীংলার সেঁচ সহ ফসলের কম পানি ব্যবহারে বিভিন্ন কলাকৌশাল, লবণাক্ত অঞ্চলে শস্য পর্যায় নির্ণয় (এলাকা ভিত্তিক), ফেরামন ফাঁদের ব্যবহার করে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন, সরিষা খেতে মৌমাছি পালন, ইনোশিটো কনজারভেশন এর মাধ্যমে বিলুপ্ত প্রায় ওষুধী গাছ ও ফসলের বীজ সংরক্ষণ, ছায়াযুক্ত স্থানে আদা, হলুদ, অড়হড়, ভূট্টা আবাদ করা, বসত বাড়িতে কালিকাপুর মডেলের সবজি উৎপাদন কৌশল, মাশরুম চাষ প্রক্রিয়া, নিম তেল, মেহগনি তেল সহ অন্যান্য জৈব কীটনাশক ব্যবহার, গাছে চুই ঝাল চাষ, সাথী ফসল চাষ, বিদেশি ড্রাগন, থাই পেয়ারা ও স্ট্রবেরি ফসলের চাষ, গাছে লতা জাতীয় আলুর চাষ, বারোমাসি মিষ্টি আলুর চাষ, পুকুর পাড়ে পতিত জায়গায় পেঁপে চাষ, লাইট ট্রাফ ব্যবহার করে ক্ষতিকর পোকাদমন, পুকুরে দেশিয় জাতের মাছ উৎপাদন ও প্রজনন, ওষুধী গাছের বাগান ও গুনাগুন মোতাবেক এর ব্যবহার, সবজি হিসাবে পাটের চাষ এছাড়াও ধান চাষের টেকনোলোজি গুলো হচ্ছে সারি গজানো বীজ বপন, লাইনে ধান রোপণ, ধান ক্ষেতে পার্সিং (ডাল পুতে পাখি বসার ব্যবস্থা) পদ্ধতিতে পোকার আক্রমন কম করা, হাইব্রিড, উচ্চ ফলনশীল এবং স্থানীয় জাত একই স্থানে রোপনের ফলে স্থানীয় ভাবে বেশি ফলনশীল, কম সময় এবং অল্পপানি ব্যবহার উপযোগী জাত চিহ্নিতকরণ, আধুনিক পানি ব্যবস্থাপনার আওতায় ডিপনালা পদ্ধতি ব্যবহার, এডব্লিউ ডি (অডউ) ব্যবহার করে পানি অপচয় রোধ, এস. আর. আই. (ঝজও) পদ্ধতিতে চারা লাগানো (প্রতি গোছায় একটি মাত্র চারা রোপণ), লবণাক্ত সহনশীল বিলুপ্ত প্রায় দেশীয় ধানের (ইনচি, পাটনাই, হাতিজোড়া, চিনিকানাই, হলদে পাটালি) আবাদ করে অনফার্ম কনজারভেশন এর মাধ্যমে উপযোগী জাত চিহিৃতকরণ কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষণ ও উদ্ভুদ্ধকরণ ।
বৈচিত্র্যময় প্রজাতি
পার্কে জৈব প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ফলজ, বনজ, ঔষুধি ও কুড়িয়ে পাওয়া সবজি ও উদ্ভিদ্ধের বৈচিত্র্য রয়েছে। ঔষধি উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের মধ্যে পাথরকুিচ, মুক্ত ঝুড়ি, তুলসি, আদাবরুন, আমরুল শাক, লজ্জাবতি, বনমুলা, লালকেউটি, শ্বেত আকন্দ, নীল অপারাজিতা, শতমূল, নিমুখো, বামুন আটি, মনিরাজ, ধুতরা কালো, বাউল জেলি, কালমেঘ, পালশফুল, ভেরান্ডা, খুদকুড়ি, বেতশাক, হাতিশুক, মিছিরপাতা, কালোকেউটে, রক্তকবরী, নয়ন তারা, কাটানটে, পাহাড়ি ধনে ইত্যাদি ওষুধি গাছ সংরক্ষণ ও সংগ্রহ করা আছে।
বিষমুক্ত সবজি
বেগুন, আলু, টমেটো, ঝিঙ্গি, ছিম, উচ্ছে, মিষ্টি আলু, লালশাক পুই শাক, আদা, হলুদ, বাদাম, কালজিরা, কলমি শাক, রসুন, বরবটি, চিচিঙ্গা, মরিচ, ঢেঢ়শ, ডাটা শাক, লাল শাক, গিমাশাক, হড়হড়া, শসা, তিল, স্ট্রবেরী, ছোলা, কচু, আখ, কুমড়া, পেয়রা, আম, ভুট্টা, পাট, গম, ধান ইত্যাদি যার সবটায় চাষাবাদ হচ্ছে জৈব সার দিয়ে। দর্শনার্থী, শিক্ষার্থী এবং কৃষকদের উপরোল্লিখিত ফলজ, বনজ, ঔষধি এবং কুড়িয়ে পাওয়া সম্পর্কে গুণাগুণ ও চাষাবাদ প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রতিনিয়ত ধারণা দেওয়া হচ্ছে।
পার্ক নিয়ে মানুষের ভাবনা
কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, “এই খামারটি স্থাপন হওয়ায় আমাদের কয়েকজন কৃষকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। কৃষি বিষয়ে বিভিন্ন কলাকৌশাল সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে পেরে নিজের খামারে লাভবান হচ্ছি।” দর্শনার্থী আব্দুল কাদের বলেন, “পার্কটি হতে পারে কৃষকদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র; তা সম্ভব হলে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে”। শিক্ষার্থী চুমকী ঘোষ বলেন, “এই খামারে এসে কৃষি বিষয়ে হাতে কলমে কৃষিবিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে পেরেছি”। শিক্ষার্থী রুবেল হাসান বলেন “অনেক ধরনের পার্ক দেখেছি কিন্তুু ফলজ, বনজ ও ঔষধি উদ্ভিদের এমন পার্ক কোথাও চোখে পড়েনি।”
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা আবু সায়েদ মোঃ মুনজুর আলম বলেন, “স্থানীয় বিভিন্ন বেসকারী সংস্থা ও কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের সহযোগিতায় এবং ইনোভেশন ইন পাবলিক সর্ভিস প্রকল্পের আওতায় এগ্রোটেকনোলোজিকাল পার্কটি গড়ে তোলা হয়েছে। ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ও কিটনাশক মুক্ত চাষাবাদে কৃষকদের উদ্ভুদ্ধ করতে সরাসরি উপজেলা প্রশাসনের তত্তাবধানে এ পার্কটি হতে পারে অনুসরণীয়।” ফসলের নতুন জাত ও প্রযুক্তি প্রসারে এগ্রোটেকনোলোজি পার্ক গুরুত্ব ভূমিকা রাখবে বলেও আশা করেন তিনি।
এগ্রোটেকনোলোজি পার্কে ফলাফলের ভিত্তিতে দেখা যায় গত ৬ মাসে হাতে কলমে ৩৫০ জন কৃষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এখানে কৃষক, শিক্ষার্থী, কৃষি বিশেষজ্ঞ, কৃষি সম্প্রসারণকর্মি সহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অসংখ্য মানুষ এসব প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করছে এবং ঔষধি ও কুড়িয়ে পাওয়া সবজি সম্পর্কে ধারণা অর্জন করছে; যা বর্তমানে চলমান রয়েছে এ উদ্যোগের মাধ্যমে ৪৫ প্রকার সবজী ও ডাল জাতীয় এবং ৫৪ প্রজাতির স্থানীয় ভেষজ উদ্ভিদের বীজ সংরক্ষণ করা হচ্ছে ইনসিটো কনজারভেশন এর মাধ্যমে। কালিকাপুর বসতবাড়ী মডেলের অনুকরণে এখামারটি করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন সাথে সাথে অভিযোজন উপযুক্ত প্রযুক্তি বিস্তারে কৃষকের দক্ষতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এছাড়াও কৃষকদের অনফার্ম কনজারভেশন উদ্ভুদ্ধ করে নিজের ফসলের বীজ সংরক্ষণ প্রযুক্তি করে বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার ফলে কৃষি উৎপাদন প্রযুক্তি বৃৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। নিজে প্রযুক্তি প্রদর্শনে সম্পৃক্ত থাকায় সম্প্রসারণকর্মীর সেলফ লার্নিংয়ের সুযোগ তৈরী হচ্ছে।