বন্ধুত্ব গড়ে উঠুক সর্বত্র মানবতার টানে
সাতক্ষীরা থেকে মো. বাহলুল করিম
এই কথাটিকে বুকে ধারণ করে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ৫ জন তরুণ শিক্ষার্থীর মনে সাধ জাগে সমাজের মানুষের জন্য কিছু করার। তারা ৫জন একত্রিত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথপোকথন করে। যে আসলে মানুষের জন্য কি করা যায় বা আমরা ৫জন কী করতে পারি? তখন তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হলো আসলে আমরা শিশু শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে পারি। তখন সবার মনে প্রশ্ন জাগল আসলে শিশুদের শিক্ষা নিয়ে আমরা কী কাজ করতে পারি? তখন প্রস্তাব হলো শিশুদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। কীভাবে সম্পর্কটা শুরু করা যাবে? এই নিয়ে ৫ জনের মনে অনেক ভাবনা চিন্তার উদ্রেগ হলো। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো আমরা তাদের খাতা ও কলম উপহার দিয়ে তাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা তৈরি করতে পারি।
“যেই ভাবা সেই কাজ ” শুরু হলো তাদের কার্যক্রম। ৫জন শিক্ষার্থী তাদের টিউশনির টাকা থেকে ২০০ করে টাকা দিয়ে ১০০০ টাকা যোগাড় করে। প্রথমে তারা সাতক্ষীরা শহরের সিলভার জুবলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩০ জন গরিব ও মেধাবী (১ম-৫ম) শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে তিনটি করে খাতা ও দুইটি করে কলম উপহার দেয়। ছাত্র-ছাত্রীদের বললো আমরা তোমাদের বড় বন্ধু আর তোমরা আমাদের ছোট বন্ধু।
এভাবে তারা ২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট তারিখে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। তারা প্রতি মাসে শিশুদের জন্য উপহার নিয়ে উপস্থিত হয়। এরপর বড় বন্ধুরা চিন্তা করল আমরা কী শুধুমাত্র একটি স্কুলে উপহারগুলো পৌছে দিব? না আরও স্কুল যোগ করতে পারি কিনা। বড় বন্ধুরা চিন্তা করল তারা কীভাবে এটাকে সম্প্রসারিত করতে পারে। তাদের উপহার দেওয়া খাতা-কলমের প্রোগ্রামটি প্রিণ্ট মিডিয়ায় দেখানো হলো। তা দেখে অনেকে এগিয়ে আসলেন বড় বন্ধুদের কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করার জন্য। এগিয়ে আসলেন একজন ডক্টর, একজন পি.টি.আই. ইনস্ট্রাক্টর, একজন সাংবাদিক, একজন ব্যবসায়ী, একজন ব্যাংকার, তাদের বন্ধু মহল ও ছোট ভাই-বোনেরা।
আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে তারা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুইটা স্কুলে ৩০ জন করে মোট ৬০ জনের হাতে তুলে দিল এই উপহারগুলো। এভাবে তারা পরবর্তীতে মোট ৪টা স্কুলে ৩০ জন করে মোট ১২০ জন গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিল উপহার। তারা প্রতিমাসে চারটি বিদ্যালয়ে ১২০ জন করে শিশুকে খাতা-কলম উপহার দিতে থাকল।
তারা এই চারটি স্কুলে গিয়ে শিশুদেরকে বিভিন্ন জ্ঞানমূলক কথা বলে। কুইজ প্রতিযোগিতা করে যাতে শিশুরা অতিরিক্ত জ্ঞান অর্জন করতে পারে। তারা বিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে ছোট বন্ধুদের সাথে মজা করে। ছোট বন্ধুদের মেধাকে বিকশিত করার চেষ্টা করে। তারা ছোট বন্ধুদের স্বাধীনতার কথা বলে। স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে বড় হওয়ার কথা বলে। বড় বন্ধুরা ছোট বন্ধুদের নিয়ে পতাকা উৎসব করে। চিত্রাংকন প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে। বড় বন্ধুরা যে উপহারগুলো দেয় তা পেয়ে ছোট বন্ধুরা খুবই খুশি হয়। বড় বন্ধুরা খুবই আনন্দিত হয় উপহারগুলো দিতে পেরে। মানুষের মত মানুষ হতে হবে এমন ধরনের কথা বলে ছোট বন্ধুদের। বড় বন্ধুরা জনসচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করে। তাদের বলে লিফলেটগুলোর উপকারিতার কথা। স্বাস্থ্য সচেনতামূলক অনেক কথা বলে “কীভাবে সুস্থ থাকা যায়?”
বড় বন্ধুরা ঈদের সময় হতদরিদ্র শিশুদের ঈদের আনন্দকে একটু ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য তাদের উপহার দেয় নতুন পোশাক। এভাবে সফলভাবে একটি বছর অতিক্রম করলো বড় বন্ধুরা। একটি বছর অতিক্রম করার পর বড় বন্ধুরা ভাবলো তারা যেভাবে উপহারগুলো দিচ্ছে সেভাবে ২০১৭ সালেও উপহারগুলো দিবে কিনা? সিদ্ধান্ত হলো এই ৪টি বিদ্যালয়ে শুধুমাত্র ৫ম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের উপহার হিসেবে ২টি বড় খাতা ও ২টি কলম দেওয়া হবে। ২০১৭ সালের প্রথম থেকে শুরু হলো শুধুমাত্র ৫ম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে উপহার সামগ্রী বিতরণ করা।
বড় বন্ধুরা যখন বিদ্যালয়ে যায় তখন ছোট বন্ধুরা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। ছোট বন্ধুরা বড় বন্ধুদের স্বাগতম জানায়। বড় বন্ধুরা তাদের খাতা ও কলমের সঠিক ব্যবহারের কথা বলে। খাতাগুলোর অপচয় যেন না করে সে ব্যাপারেও সাবধান করে তাদের। ২০১৭ সালের যারা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার্থী তাদের জন্য বড় বন্ধুরা ভিন্নধর্মী আয়োজন করে। তাদের প্রত্যককে ১টি ক্লিয়ার ব্যাগ, ১টি স্কেল, ১টি পেনসিল, ১টি রাবার ও ২টি কলম উপহার হিসেবে প্রদান করে। উপহারগুলো পেয়ে ছোট বন্ধুরা খুবই আনন্দিত হয়। ছোট বন্ধুরা বলে তাদের এই উপহারগুলো পরীক্ষার জন্য অনেক কাজে দিবে।
বড় বন্ধুরা ইতিমধ্যে একটি উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। তারা ছোট বন্ধুদের মাঝে ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক’ চলচিত্র প্রদর্শনের কথা ভাবছে। ২০১৮ সালের প্রথম দিকে তারা ছোট বন্ধুদের মাঝে উপহার হিসেবে দিতে চাচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক’ চলচিত্র প্রদর্শনী। বড় বন্ধুরা ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক’ চলচিত্র প্রদর্শনির জন্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও নতুন বছরে ছোট বন্ধুদের জন্য নতুন কিছু করা যায় কিনা? সেটাও চিন্তা করছে বড় বন্ধুরা। ছোট বন্ধুদের সৃজনশীল মেধাকে আরও বিকশিত করা যায় কীভাবে সেটাও চিন্তা করছে বড় বন্ধুরা। এভাবেই বড় বন্ধুরা ছোট বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্বের সেতু বন্ধন তৈরি করে যেতে চায়। এটাই প্রত্যাশা সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে।
যে কোন ছোট উদ্যোগ বদলে দিতে পারে কোন সমাজ, কোন শহর, কোন দেশ বা কোন রাষ্ট্রকে। তেমনি বড় বন্ধুরা চায় এই শহরের প্রতিটি বিদ্যালয়ে তাদের বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে। এই বড় বন্ধুরা আর কেও নয় “আমরা বন্ধু” নামে পরিচিত সাতক্ষীরা শহরের সকল স্তরের মানুষের কাছে। সকল ছোট বন্ধুরা জানে বড় বন্ধু মানে হলো “আমরা বন্ধু”।