হারিয়ে যাচ্ছে ভেন্না
সাতক্ষীরা থেকে বাহলুল করিম
সংরক্ষণের অভাব, কেটে ফেলা, অসচেতনতাসহ বিভিন্ন কারণে হরিয়ে যাচ্ছে পরিবেশবান্ধব ও মহাঔষধি গাছ ভেন্না। কাঁটা অংশ জোড়া লাগাতে, চুলপড়া রোধে, মুখের রুচি বাড়াতে, বাত ব্যথায়, ক্ষত সারাতে, মাড়ির যে কোন সমস্যায় ভেন্না গাছ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এর বীজ থেকে উৎপাদিত তেলেও রয়েছে জাদুকরী ঔষধি ক্ষমতা।
রাস্তার আশেপাশে, বনে-বাদাড়ে, বাড়ির আনাচে-কানাচে ভেন্না গাছ দেখতে পাওয়া যায়। ক্ষেত-খামারের বেড়া তৈরিতে এই গাছ বেশি লাগানো হয়। এর ডাল দাঁতের মাজন হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ভেন্নার আঠা থেকে এক ধরনের বুদবুদ তৈরি হয় যা বাচ্চাদের আনন্দ যোগায়।
মুক্তকোষ উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, ‘ভেন্না বা রেড়ি গুল্ম প্রকৃতির বহুবর্ষজীবি এক ধরনের কাষ্ঠল উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Ricinus communis। এর পাতা দেখতে অনেকটা পেঁপে বা পান পাতার মতো। ভেন্না সাদা, লাল ও কালো এই তিন প্রজাতির হয়ে থাকে। অনেকের কাছে এটা ভ্যান্না, ভেরেণ্ডা, রেড়ি, ভেন্না, কচা, বেড়া গাছ, এর-, কাস্টার ওয়েল প্লান্ট নামে পরিচিত।
ভেন্না গাছ ১০-১৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। গাছের কাণ্ডের ভেতরটা সাধারণত ফাঁপা। এদের কাণ্ডের বেড় ৫-৬ ইঞ্চি। কাণ্ডের ৫-৬ ইঞ্চি দূরে একটি করে গিঁট থাকে। প্রতিটি গিট থেকে একটা করে পাতা বের হয়। সাধারণত বর্ষাকালে ভেন্নার চারা গজায়। প্রতিবছর হেমন্ত ও শীতকালে ভেন্নার ফুল ও ফুল হয়। সবুজ ফলের গায়ে নরম কাটাও থাকে।’
তবে সাতক্ষীরাতে এটি ভেন্না, ভ্যান্না বা কচা গাছ নামে অধিক পরিচিত। বেড়া তৈরিতে ব্যবহৃত হলেও ভেন্নায় রয়েছে ঔষধি গুণাগুণ। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আমানুল্লাহ-আল-হাদী বলেন, “ভেন্নার বীজ থেকে এক ধরনের তেল উৎপন্ন হয়। যা মানব শরীরের জন্য খুবই উপকারী। ইংরেজিতে বলা হয় ক্যাস্টার ওয়েল। ক্যাস্টার ওয়েল বাজারে পাওয়া যায়। এই তেল চুলপড়া বন্ধ করে। এর তেল সারা শরীরে মাখলে ত্বকও ভালো থাকে।”
তিনি আরও বলেন, “ভেন্না গাছের পাতা ভাঙলে এক ধরনের আঠা বের হয়। এই আঠা থেকে এক ধরনের বুদবুদ তৈরি হয়। শিশুরা এই বুদবুদ নিয়ে খেলা করে অনেক আনন্দ পায়।”
ব্রহ্মরাজপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. কফিল উদ্দীন বলেন, “ভেন্না গাছের আঠা কিছুটা এ্যান্টিসেপটিকের কাজ করে। শরীরের কোথাও ঘাঁ হলে ভেন্নার আঠা লাগালে ভালো উপকার পাওয়া যায়। দাঁতের গোড়ায় এবং মাড়িতে ব্যথা হলে ও ফুলে গেলে এর ডাল দিয়ে দাঁত মাজলে উপকার পাওয়া যায়।”
শহরের পুষ্টির ফেরিওয়ালা রুহুল কুদ্দুস বলেন, “ভেন্না এক ধরনের ঔষধি গাছ। ভেন্না সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে। সাদা, লাল ও কালো ভেন্না। কালো ভেন্না আমাদের এখানে তেমন দেখা যায় না। তবে আমাদের এখানে সাধারণত সাদা ভেন্না পাওয়া যায়। প্রত্যেক প্রজাতির ভেন্নায় আলাদা ঔষধি গুণাগুণ আছে।”
তিনি আরও বলেন, “ভেন্নার আঠা রক্ত আমাশয় রোগীকে খাওয়ালে দ্রুত ভালো হয়ে যায়। এছাড়া এর আঠা কাটা অংশে লাগালে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যাায় ও কাটা অংশ জোড়া লাগে। ভেন্না গাছ কেটে ফেলার কারণে এখন আর তেমন দেখা যায় না।”
তুজুলপুর গাছের পাঠশালার উদ্যোক্তা ইয়ারব হোসেন বলেন, “বনে-বাদাড়ে, বাড়ির আনাচে-কানাচে এই ভেন্না গাছ পাওয়া যায়। পরিবেশবান্ধব ভেন্না গাছ এখন আর দেখা যায় না। ভেন্না গাছ স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। সচেতনতার অভাবে এই গাছ কেটে ফেলা হয়। সংরক্ষণ না করার ফলে দিন দিন ভেন্না গাছ পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “ভেন্নার বীজ থেকে এক ধরনের তেল তৈরি হয়। দুই কেজি ৫০০ গ্রাম ভেন্নার ফল থেকে এক কেজি তেল পাওয়া যায়। একে রেড়ি তেলও বলা হয়। এই তেল ভাতের সাথে মাখিয়ে খেলে মুখের রুচি বাড়ে। মেয়েরা এর তেল মাথায় মাখে। ফলে মাথার তালু ঠাণ্ডা থাকে। শরীরের বিভিন্ন কালো দাগ, মেছতার দাগ ও পোড়া দাগ দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। বুকের ব্যথা ও বাত ব্যথায় এই তেল মালিশ করলে ভালো উপকার পাওয়া যায়। একে গরিবের তেলও বলা হয়। এই তেল আগে ভৈজ্য তেল হিসেবে ব্যবহার করতো দরিদ্র মানুষ। সচেতনতার অভাবে ভেন্নার তেলের ব্যবহার কমে গেছে।”
পারিবারিক ঔষধের চাহিদা অনেকাংশে মিটিয়ে থাকে এই ভেন্না। সংরক্ষণের অভাবে ঔষধি বৃক্ষ ভেন্না দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে পরিবেশ থেকে। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মহাঔষধি ভেন্না গাছ সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি। বিনা খরচে পতিত জমিতে ভেন্না গাছ চাষ করে পারিবারিক ঔষধের চাহিদা মেটানো সম্ভব।